December 3, 2024, 8:43 pm
রাজশাহী থেকে মোঃ হায়দার আলীঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলাসহ বিভন্ন অঞ্চলের সীমান্ত পথে ব্যাপক হারে আসছে মাদক, বিনিময়ে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে স্বর্ণ। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে পাচারে লাগাম দিতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী সীমান্তে স্বর্ণের একটি বড় একটি চালান আটক হলেও মূলহোতাদের
এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ।
অভিযোগ উঠেছে, আলোচিত স্বর্ণ পাচার মামলায় পলাতক দুই আসামিকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। একইভাবে সম্প্রতি সীমান্তে মাদকের কয়েকটি বড় চালান র্যাব উদ্ধার করলেও এসব মাদকের মূল মালিকরা ধরা পড়েনি। ফলে সীমান্ত পথে বন্ধ হচ্ছে না মাদক ও স্বর্ণ পাচার। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তারা মাদক পাচার বন্ধে যেমন তৎপরতা চালাচ্ছে তেমনি সীমান্ত পথে স্বর্ণ পাচার প্রতিরোধেও কাজ করছেন।
ওই সব মাদক ও সোনা পাচারকারীদের নদীর ওপারে এবং এপারে দুপারে বাড়ী থাকার সুবাধে এপারে অভিযান শুরু হলে ওপারে গিয়ে আত্নগোপন করে ওপারে অভিযান শুরু হলে তারা এপারে পালিয়ে আসেন। ফলে আইন শৃঙ্খলা বাহনীর অভিযান খুব একটা সফল হয় না। মাদক পাচারের সাথে যুক্ত কয়েক শ লোক স্বল্প সময়ে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন। কেউ কেউ নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব খাটিয়ে হয়েছেন মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেম্বার, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা পাতি নেতা, স্কুল কলেজ মাদ্রাসার কমিটির সভাপতি, সদস্য সঙ্গত কারণে তারা আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যর তালিকভুক্ত মাদকব্যবসায়ীরা বীরদাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখার যেন কেউ নেই। কিছুদিন পূর্বে মাদকবিরোধী অভিযান চলার সময় যেসব তালিকাভুক্ত মাদকব্যবসায়ীরা পালিয়ে গিয়েছিল ওইসব মাদকব্যবসায়ীরা এখন প্রশাসনের সাথে সুস্পর্ক রেখে চলেছেন বলে ব্যপক অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর হাটপাড়া ঘাট দিয়ে সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে বিজিবির মহিষালবাড়ি সীমান্ত ফাঁড়ির জওয়ানরা সাতটি স্বর্ণের বারসহ মুক্তার হোসেন নামের একজনকে গ্রেফতার করেন।
অভিযান পরিচালনাকারী বিজিবির সুবেদার আইনুদ্দীন জানান, মুক্তার হোসেন লুঙ্গির খুঁটের ভেতরে লুকিয়ে ৫৫ লাখ টাকা মূল্যের ৭টি স্বর্ণর বার নিয়ে খেয়া নৌকায় চড়ে সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তার হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া মুক্তার হোসেনের বাড়ি গোদাগাড়ী সংলগ্ন আলাতুলি ইউনিয়নের বকচর গ্রামে। বিজিবি বাদী হয়ে গোদাগাড়ী থানায় একটি মামলা করেন।
এদিকে, মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, মুক্তার হোসেন স্বর্ণসহ আটক হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিজিবিকে জানায়, এই ৭টি স্বর্ণের মালিক চাঁপাইনবাগঞ্জের চরবাগডাঙ্গার জহির (৪৭) ও হরিশপুর গ্রামের জমির আলী। মুক্তার আলীর জবানবন্দি মোতাবেক জহির ও জমিরকেও এ মামলায় আসামি করা হয়।
এই মামলাটি তদন্ত করছেন রাজশাহীর এলআই বিজিবির এসআই তাজুল ইসলাম। তবে পুলিশ বিভিন্ন মহলের তদবিরের ফলে আলোচিত মামলাটির চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি গত ৬ মাসেও। মামলাটির তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার রাজশাহীর এলআই বিজিবির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক সৌমিক কুণ্ডু এ প্রতিবেদকে বলেন, মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশমতো দ্রুত সময়ে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত পথে ভারতে স্বর্ণ পাচার অব্যাহত রয়েছে। দুবাই ও চট্টগ্রামভিত্তিক একাধিক পাচার চক্রের সহযোগীরা রাজশাহী অঞ্চলেও সক্রিয় রয়েছে স্বর্ণ পাচারে। স্বর্ণ পাচারের টাকায় মাদক আসছে বাংলাদেশে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। স্বর্ণ ও মাদক সেইফ মাল হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে সহজে ফাঁকি দিয়েই পাচার কাজ চালাচ্ছে সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা।
গভীর অনসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজশাহী মহানগরীর ভদ্রায় ১৭ টি স্বর্ণর বার ছিনতাই হয়। এসব স্বর্ণ পাচারের জন্য চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে আনেন জেলার পুঠিয়ার দুই ভাই দ্বিজেন ধর ও জিতেন ধর। পরে পুলিশ ছিনতাই হওয়া স্বর্ণের ১৭টি বার উদ্ধার করেন। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে- চট্টগ্রামের দুবাই পার্টির কাছ থেকে স্বর্ণের বারগুলো কিনে রাজশাহীতে আনা হয় ভারতে পাচারের জন্য। তার আগেই পথিমধ্যে ছিনতাই হয়। এই ঘটনায় নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা হয়। গ্রেফতার করা হয় স্বর্ণ পাচারকারী জিতেন ধরকে।
এদিকে, ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সীমান্তবর্তী সুলতানগঞ্জে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একটি মাইক্রোবাস থেকে ১৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জ জেলার জানপুর গ্রামের লিটন আলী শেখকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়।
লিটন শেখ অভিযানিক দলকে জানায়, এসব স্বর্ণ সীমান্ত পথে ভারতে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। এসব স্বর্ণের মালিক আনারুল ও আমিনুল নামের দুই ভাই। তবে বাহক আটক হলেও মালিকরা কেউ আজও ধরা পড়েনি।
অন্যদিকে, ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পুঠিয়ার বেলপুকুর চেকপোস্টে ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বাসযাত্রীর স্যান্ডেলের ভেতর থেকে ১২টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে বিজিবি। আটক হওয়া ঢাকার ধামরাই উপজেলার চৌহাট গ্রামের আলাল আলীকে (৪৫) গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়নশুকা কামারপাড়া গ্রামের শুভ্র কর্মকার (২৭) ও বারঘরিয়ার মিলন হালদারকে গ্রেফতার করা হয়।
২০২০ সালের ৪ অক্টোবর নগরীর বর্ণালী মোড়ে ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একটি বাসের যাত্রী আজিজুল ও ফারুককে আটক করে তাদের কাছ থেকে ৪টি স্বর্ণর বার উদ্ধার করে পুলিশ। আসামিরা কাতার থেকে এসব স্বর্ণ আনেন। তারা এসব স্বর্ণ সীমান্ত পথে ভারতে পাচার করতেন বলে পুলিশকে জানায়।
এদিকে, গত ১৩ আগস্ট রাতে রাজশাহী র্যাবের একটি দল গোদাগাড়ীর সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলির জেলেপাড়া চরের জিয়ারুলের বাড়ি থেকে সাড়ে ৪ কেজি বাউন সুগার বা উন্নতমানের হেরোইন জব্দ করে। গ্রেফতার করা হয় জিয়ারুলকে।
জিয়ারুল র্যাবকে জানায়, এসব হেরোইন ভারতের লালগোলা থেকে তার কাছে আসে। গোদাগাড়ী হয়ে দেশের অন্যত্র পাচারের জন্য রাখা হয়েছিল। এসব হেরোইনের মালিকদের নাম পেলেও র্যাব গ্রেফতারের স্বার্থে তাদের নাম বলেনি।
এদিকে, পুলিশ ও র্যাবের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও গোদাগাড়ী সংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি এলাকাটি পদ্মার চরবেষ্টিত। এসব চরে ছোটবড় ১০টি গ্রাম রয়েছে সীমান্ত ঘেঁষে। এসব পথে একদিকে যেমন মাদকের চালান আসছে তেমনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হচ্ছে স্বর্ণ। আগে স্বর্ণ পাচারের বিনিময়ে গরু ও মাদক আসত। এখন গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ। ফলে স্বর্ণর বিনিময়ে আসছে মাদকের চালান।
গোদাগাড়ী মডেল থানার ওসি মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের নিয়মিত কাজের সাথে মাদক ও সোনা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। এরা যতই শক্তিশালি হউক না কেন তারা ছাড় পাবে না।
রাজশাহীস্থ র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ভারত থেকে মাদক পাচারের বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে বলেও আমরা খবর পাচ্ছি। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব-৫ বেশ কয়েকটি বড় অভিযান করে বিপুল মাদক উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। কারা সীমান্ত পথে মাদক ও স্বর্ণ পাচারে জড়িত, তাদের শনাক্তে র্যাবের গোয়েন্দা দল মাঠে কাজ করছে। যুবসমাজ ও দেশের অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে জরুরী ভিক্তিতে মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন।
মোঃ হায়দার আলী
রাজশাহী।