নড়াইলে মধুর উৎপাদন বাড়লেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেনা চাষীরা

উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে:
নড়াইলে উৎপাদন বাড়লেও মধুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেনা চাষীরা। স্বল্প বিনিয়োগে ভালো লাভ ও অনুকূল পরিবেশ থাকায় নড়াইলে মৌচাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই এ জেলায় বাড়ছে মধু উৎপাদন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর মধু উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল মৌসুমের অর্ধেক সময়ের মধ্যেই সে লক্ষ্য ছুঁয়েছেন জেলার মৌ-খামারিরা। সব ঠিক থাকলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ মধু উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরিষা খেত থেকে মধু সংগ্রহ করায় ফলনও বেড়ে গেছে। উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে জানান,
উৎপাদন বাড়লেও স্থানীয় চাষীরা মধুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। খামারিদের অভিযোগ, খেত থেকে পাইকাররা মধু কিনে নিয়ে গেলেও দাম কম দিচ্ছেন। সরকারিভাবে মধু সংগ্রহ করার দাবি জানিয়েছেন মৌ-খামারিরা।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে (২০১৮ সালে) নড়াইলে মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র দুই টন। প্রতি বছরই মধু উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৬ টন। এ বছর মৌসুমের অর্ধেক সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে গেছে। জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে মৌ-খামারির সংখ্যা শতাধিক। আর নিবন্ধনকৃত খামারির সংখ্যা ৭০। খামারির সংখ্যাও প্রতি বছর বাড়ছে।
খামারি বসির আহমেদ জানান, ১০০টি মৌ-মাছির বাক্স থেকে চলতি মৌসুমের তিন মাসে ৫৪ মণ মধু সংগ্রহ করেছেন। আগামী তিন মাসে আরো অন্তত ৫০ মণ মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা তার।
আরেক খামারি মো. জুয়েল বলেন, ‘আমার ৫০টি বাক্স থেকে এরই মধ্যে ৩০ মণ মধু সংগ্রহ করেছি। অনুকূল পরিবেশ থাকলে বাকি সময়ে আরো ২০-২৫ মণ মধু উৎপাদন করতে পারব।’ পৌরসভার পুরাতন বাজার এলাকার মধুচাষী খন্দকার মাকসুদ হাসান জানান, এ বছর পাইকাররা প্রতি মণ মধু ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা দাম দিচ্ছেন। এত কম টাকায় মধু বিক্রি করলে তাদের কোনো লাভ হয় না। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত তার ৮৩ মণ মধু সংগ্রহ হয়েছে। এরই মধ্যে ৪ হাজার ২০০ টাকা দরে দুই টন মধু পাইকারি বিক্রি করেছেন। তিনি সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যে মধু সংগ্রহ করার দাবি জানান
আকাশ শেখ নামে এক খামারি অভিযোগ করে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মধুর দাম কম দিচ্ছেন। লাভের অংশ পুরাটাই ব্যবসায়ীদের পকেটে যাচ্ছে। অথচ নড়াইল শহরের বিভিন্ন দোকানে ৪০০-৫০০ টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি হচ্ছে।’
জানা গেছে, মধু আহরণের মৌসুম নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। এ ছয় মাসে মৌ-খামার নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটতে হয় মৌ-চাষীদের। যেখানেই ফসলের মাঠজুড়ে সরিষা, মসুর, খেসারি, তিল, তিসি, ধনিয়াসহ নানা ফুলের হাতছানি সেখানেই মধু আহরণে আস্তানা গাড়েন মৌ-চাষীরা। নভেম্বরে সরিষা, মসুর, খেসারি, ধোনে ফুলসহ বিভিন্ন রবি ফসলে ফুল এলে নড়াইলসহ পাশের মাগুরা ও ফরিদপুর জেলায় মধু সংগ্রহ শুরু করেন তারা। লিচু ফুল থেকে মধু আহরণ করতে গাজীপুর, পাবনা, যশোরেও চলে যান তারা। এভাবে সর্বশেষ মে মাসে সুন্দরবনে গেওয়া, গরান, খলিষা, বাইন, কেওড়া ফুলের মধু আহরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় মধু সংগ্রহের মৌসুম
খলিষা, বাইন, কেওড়া ফুলের মধু আহরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় মধু সংগ্রহের মৌসুম।
মৌ-চাষীরা জানান, বর্ষার আগমনে মধু আহরণ মৌসুম শেষ হয়। বর্ষাকালীন মৌ-খামার পরিচর্যার জন্য নড়াইল অত্যন্ত উপযুক্ত স্থান। এ সময় প্রকৃতিতে বিশেষ কোনো ফুল না থাকলেও এ অঞ্চলে নারিকেল, সুপারি গাছের প্রাচুর্যের ফলে বর্ষায় এর ফুল থেকে আহরণকৃত মধু মৌমাছির জীবন ধারণ ও বংশবিস্তারে অত্যন্ত সহায়ক। তাই বর্ষাকালে পাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও চাষীরা খামার নিয়ে নড়াইলে চলে আসেন। জুন-নভেম্বর—এ ছয় মাস প্রকৃতিতে ফুল তথা মধুর সংকটে মৌমাছিদের খাদ্য হিসাবে চিনিমিশ্রিত পানি সরবরাহ করা হয়।
মৌ-চাষী নাসিম শেখ জানান, উদ্যোগের অভাবে বাজার সম্প্রসারিত না হওয়ায় উৎপাদিত মধু বিক্রি করতে তাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। উপরন্তু বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানির মধু দেশে আমদানি করা হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে কষ্টার্জিত মধু বিক্রি করতে হয় কখনো নামমাত্র মূল্যে কখনো বাকিতে। তা না হলে প্রচুর মধু অবিক্রীত থেকে যায়। ফলে মধুর ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মৌ-চাষীরা। তার দাবি সরকারিভাবে চাষীদের কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করা হোক।
বিসিক নড়াইল জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছরের চেষ্টায় মৌ-চাষের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বিসিক আধুনিক প্রযুক্তিতে মৌচাষ প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে মৌচাষীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। জেলায় মৌ-চাষীদের উন্নয়নে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া হয়েছে। আগামীতে আরো কিছু খামারিকে ঋণ দেয়ার পরিকল্পনা আছে। তাদেরকে মৌ-বাক্সসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে নতুন নতুন মৌচাষী তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করছি অল্পদিনের মধ্য নড়াইল জেলা মৌচাষে একটা উদাহরণ তৈরি করবে।’

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *