January 15, 2025, 6:49 am
পঞ্চগড় হতে মোহাম্মদ বাবুল হোসেন ;
২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের পর পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের প্রবেশ মুখেই গড়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলীম মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এবতেদায়ী শাখার প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন মাহাবুব আলম নামের এক ব্যক্তি। বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে বিনা বেতনেই পাঠদান করাচ্ছেন তিনি। এজন্য তার বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দুরের এই মাদ্রাসায় গত ৮ বছর ধরে তিনি বাইসাইকেলেই যাতায়াত করছেন। যোগদান কালে দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠান প্রধানের শর্তমতে কষ্টার্জিত মোটা অংকের উৎকোচও। এতসব কষ্টের মাঝে মাহবুবের স্বপ্ন ছিলো মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হবে; মাস গেলে মিলবে বেতন, দুর হবে সব কষ্ট। তবে দীর্ঘদিন পর মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত’র মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ হলেও মাহবুবের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ, রয়েছেন চাকরি হারাবার অজানা আতঙ্কে।
শুধু মাহাবুব আলম নন, তার মত ওই মাদ্রাসাটির আরও ৩০-৩৫ জন শিক্ষক ও কর্মচারি এখন চাকরি হারাবার আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। তাদের পরিশ্রমে সাফল্য দেখা মাদ্রাসাটিতে নতুন নিয়োগের পাঁয়তারা করছেন মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক। পুরনো জনবলদের চাকুরিচ্যুত করে নতুন নিয়োগ প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে। শিক্ষক ও কর্মচারির হাজিরা খাতা গায়েব করার অভিযোগসহ মাদ্রাসা পরিচালনাতেও রয়েছে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ।
সম্প্রতি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা ও ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি মফিজার রহমান।
অভিযোগে তিনি জানান, অধ্যক্ষ তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে অবৈধভাবে ম্যানেজিং কমিটি গঠণের পাঁয়তারা করছেন। গোপনে তার মনোনীত প্রার্থী নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন তিনি। কোন প্রতিদ্বন্দী নেই উল্লেখ করে ম্যানেজিং কমিটি গঠণ করার চেষ্টা করছেন অধ্যক্ষ মোজাম্মেল। অথচ মাদ্রাসার কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী ও এই মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকগণ এই ম্যানেজিং কমিটি গঠণ বিষয়ে কিছুই জানেননা।
মফিজার রহমান অভিযোগে উল্লেখ করেন, অসত্য তথ্য প্রদান, তথ্য গোপন করা ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮’ এর অনুচ্ছেদ ১৭.৩ এর পরিপন্থি। ১৭.৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ ম্যানেজিং কমিটি গঠণ না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা শিক্ষা অফিসার সভাপতির স্থলে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু এসব নীতিমালা তোয়াক্কা না করে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক কোন ক্ষমতাবলে গোপনে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের চেষ্টা করছে তা বোধগম্য না। ইতিপূর্বেও এই অধ্যক্ষের বিভিন্ন দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সংশ্লিষ্ট সকলে ।
মফিজার রহমান বলেন, আমি ছিটমহল স্বাধীন করে পরবর্তীতে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করি। অথচ আমার অগোচরে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন অনিয়ম ও ষড়যন্ত্র করেই চলছেন। এখনি তার ষড়যন্ত্রের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে এই মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করি।
জানা গেছে, ছিটমহল বিনিময়ের পর পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলিম মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন ছিটমহল আন্দোলনের নেতা মফিজার রহমান। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে মাদ্রাসাটিতে তার অবদান অসামান্য। এবতেদায়ী, দাখিল ও আলীম স্তরে মোট ৫৪ জন শিক্ষক-কর্মচারি নিয়ে পথচলা শুরু করে মাদ্রাসাটি। সকলের আন্তরিকতায় মাদ্রাসাটি সাফল্য পেতে শুরু করে। প্রতি বছর দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য ফলাফল। সম্প্রতি মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হয়েছে।
মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকেই অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক নানান ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন করে নিয়োগ বাণিজ্য করতে চাচ্ছেন তিনি। তারা অভিযোগ বলেন, আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে শুরু থেকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। অথচ অধ্যক্ষ মহোদয় আমাদের সঙ্গে কোন পরামর্শ না করেই একক সিদ্ধান্তে চলেন। আমাদেরকে চাকুরিচ্যুত করার নীল নকশা আটছেন তিনি। আমরা ২০১৫ সাল থেকে কর্মস্থলের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে আসছি। অথচ গত ১৬ ফেব্রুয়ারী মাদ্রাসায় হাজিরা খাতা না পেয়ে উপস্থিতির স্বাক্ষর করতে পারিনি। শুধু তাই নয় অধ্যক্ষ নিয়মিত প্রতিষ্ঠানেই আসেননা, শুধু বাইরে থেকে মাদ্রাসাটি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছেন।
মাদ্রাসার সহকারি মৌলবী শিক্ষক নুর নবী বলেন, পড়ালেখা শেষ করে বড় আশা নিয়ে এখানে যোগদান করেছি। অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টা করিনি। শুরু থেকেই সময়, শ্রম এবং অর্থ দিয়ে এখানে লেগে আছি। এখন যদি আমার জায়গায় অন্য কাউকে চাকরি দেয়া হয়, তাহলে বেঁচে থাকাই কঠিন হবে।
তিনি বলেন, মারাত্মকভাবে হতাশায় ভুগছি। এরমধ্যেও নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে আসতেছি। চাকরিরও বয়স শেষ যে অন্য কোথাও চেষ্টা করবো। গত একবছর ধরে এসব চিন্তা করতে গিয়ে ঘুমাতেও পারছিনা।
মাদ্রাসাটির উপাধ্যক্ষ এরশাদ আলী বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে মাদ্রাসাটিতে লেগে আছি। সবার প্রচেষ্টায় আজকে এতদুর আসতে পেরেছি। অধ্যক্ষ মহোদয় তার মন মত চলছেন। আমার সঙ্গেও কোন পরামর্শ করেননা। মাদ্রাসার নতুন কমিটি গঠণের বিষয়েও জানাননি। এ অবস্থায় যদি কোন ষড়যন্ত্র হয়, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবো।
এ বিষয়ে কথা বলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
পঞ্চগড় সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, এখনো কোন কমিটি অনুমোদন হয়নি। কমিটি চূড়ান্ত করার আগে আমরা প্রতিষ্ঠানে যাবো, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবো। শিক্ষার্থীরা কমিটির বিষয়ে না জানলে ওই কমিটি বাতিল হবে। আর পুরনো শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নতুন নিয়োগের সুযোগ নেই, যদি নিয়োগ দিতে হয় তাহলে এনটিআরসি দিবে।