July 1, 2025, 4:14 pm
পঞ্চগড় প্রতিনিধি ।।
পঞ্চগড় শহরের জালাসী-টুনিরহাট সড়কের পাশে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ময়লার বিশাল ভাগাড় থেকে নির্গত দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করলেও, নাক চেপে চলাই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবর্জনার দুর্গন্ধে পথচারী, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাপন এখন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে একই স্থানে পৌরসভার সব বর্জ্য ফেলায় ভাগাড়টি এখন বিশাল স্তুপে রূপ নিয়েছে। পচা খাবার, হোটেল-রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, এমনকি মৃত পশুর দেহ পর্যন্ত সেখানে ফেলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি রয়েছে মেডিকেল বর্জ্য, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“নাক চেপে হাঁটি, অনেক সময় বমি চলে আসে”
ভাগাড়টির পাশেই অবস্থিত পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। দশম শ্রেণির ছাত্র গৌতম চন্দ্র রায় বলেন, “স্কুল যাওয়া-আসার সময় দুর্গন্ধে নাক-মুখ চেপে রাখতে হয়। এমন পরিবেশে প্রতিদিন চলাফেরা করা যায় না।”
মেঘলা নামে আরেক শিক্ষার্থী জানান, “গন্ধে অনেক সময় ক্লাসে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বারবার বলার পরও কেউ ব্যবস্থা নেয় না। আমরা চাই, এই ভাগাড় অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক।”
ইশাত হোসেন নামের এক পথচারী বলেন, পঞ্চগড় শহরের একটি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পাশে গড়ে ওঠা এই ময়লার ভাগাড় এখন এক ভয়াবহ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির নাম। দ্রুত, কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান না হলে এই অসহনীয় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
ভ্যানচালক মশিউর বলেন, “বৃষ্টির সময় ভাগাড়ের ময়লা পানি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। বড় গাড়ি গেলে সেই পানি শরীর ও কাপড়ে ছিটে আসে।” আরেক চালক জমির উদ্দীন বলেন, “এখানে এলেই দম বন্ধ হয়ে আসে, যাত্রীরাও বমি করে ফেলে অনেক সময়।”
ভাগাড়ে মাঝে মাঝে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন পথচারী লিটন। তিনি বলেন, “পুড়ে যাওয়া বর্জ্য থেকে যে ধোঁয়া বের হয়, তা এমন তীব্র যে দম নেওয়া যায় না।”
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সামিম হোসেন বলেন, “একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে এভাবে বর্জ্য ফেলা খুবই বিপজ্জনক। এর প্রভাবে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়বে। এটি দ্রুত সরানো এবং কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
পঞ্চগড় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইউসুফ আলী জানান, “পৌরসভার জন্য নির্ধারিত স্যানেটারি ল্যান্ডফিল্ড ও পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগার ব্যবহারের অনুমোদন আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দিয়েছি। কিন্তু পৌরসভা তা না করে এখনও সড়কের পাশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেলে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সর্বশেষ ২০২২ সালের শেষ দিকে ময়লার ভাগাড়টি পরিদর্শন করেছি। এরপর আর কোনো পরিদর্শন করা হয়নি।”
পঞ্চগড় সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. মাহাবুব রহমান সুমন বলেন, “সড়কের পাশে ময়লার ভাগাড় থেকে নির্গত গ্যাসের কারণে শ্বাসতন্ত্রের নানা সমস্যা, ফুসফুসের সংক্রমণ ও অ্যালার্জিজনিত রোগ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব ক্ষতিকর গ্যাস শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।”
তিনি আরও বলেন, “ রাস্তার পাশে এভাবে ভাগাড় রাখা একেবারেই অনুচিত। এর ফলে শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।”
অন্যদিকে, সিভিল সার্জন ডা. মো. মিজানুর রহমান জানান, “সদর হাসপাতালে ইনসিনারেটর নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। এটি চালু হলে মেডিকেল বর্জ্য আর বাইরে ফেলতে হবে না।”
চালু হয়নি পরিশোধনাগার, কোটি টাকার প্রকল্প অনির্বাহ : ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন একর জমির ওপর ভাগাড় আধুনিকায়নের জন্য শুরু হয় স্যানেটারি ল্যান্ডফিল্ড ও পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপনের কাজ। যদিও প্রকল্পটি দুই বছর আগে শেষ হয়েছে, এখনো তা চালু করতে পারেনি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। ফলে সম্ভাব্য জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ।
পৌর প্রশাসনের বক্তব্য: পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পৌর প্রশাসক সীমা শারমিন বলেন, “স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছি। ইতোমধ্যে ডাস্টবিন তৈরি, জনসচেতনতায় মাইকিং ও ডোর টু ডোর প্রচার শুরু হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “গত এপ্রিল মাসে ল্যান্ডফিল্ডের চারপাশে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুর্গন্ধ কমাতে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার এবং অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আরইউটিডিপি প্রকল্পে বরাদ্দ পেলে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব।”