February 23, 2025, 6:02 am
আলিফ হোসেন,তানোরঃ
রাজশাহীর প্রচন্ড খরাপ্রবণ বৃহত্তর
বরেন্দ্র অঞ্চলে ফসলের মাঠগুলো এখন সবুজে সবুজে ভরে উঠেছে। এক ফসলি জমিতে এখন তিন থেকে চারটি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এসব জমিতে চাষাবাদ করতে একটা সময় মান্ধাতা আমলের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো কৃষকদের। বছরে প্রকৃতির বৃষ্টি নির্ভর একটি ফসল উৎপাদন করা যেতো। তার পরেও বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি,খরা ও ঝড়-ঝাপটা ছিলো নিত্যসঙ্গী। অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে মাঠের ফসল মাঠে পড়ে থাকতো। তবে বিএমডিএ’র গভীর নলকুপ সেচ প্রকল্প কৃষিতে নতুন দিগন্তের সুচনা করেছে।বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছেন। বিএমডিএ’র গভীর নলকুপ সেচ প্রকল্পের কল্যাণে প্রচন্ড খরাপ্রবণ অঞ্চলের এক সময়ের পতিত জমি গুলোতেও এখন সারা বছরই তিন থেকে চারটি করে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে।
রাজশাহীর তানোর,গোদাগাড়ী,নওগাঁর নিয়ামতপুর,পোরশা,নজিপুর,সাপাহার,চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল,ভোলাহাট, গোমম্তাপুরসহ অধিকাংশ এলাকায়
এক সময় চৈত্র-বৈশাখ মাসে দুপুরের
প্রচন্ড রোদে মাঠের দিকে তাকাতেও সমস্যা ছিল মনে হতো মরুভূমির মতো।
কিন্ত্ত এখন এসব মাঠের দিকে দৃষ্টি রাখলে দেখা যায় অপরুপ শোভা ছড়াচ্ছে সবুজ ধান গাছের পাতা। চারিদিকে সবুজ ফসলের খেত দুরে দেখা যায় এক একটি সবুজ গ্রাম।
সবুজের খেতে আকাশটি হেলে পড়ায় দিগন্তে মিশে গেছে। এ এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকুপ স্থাপন করায় এখন সারা বছর জুড়েই
বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে। বিএমডিএ’র গভীর নলকুপ সেচ প্রকল্প এলাকার কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নে বড় ভুমিকা রাখছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে,বিগত ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(বিএমডিএ)।দেশের উত্তরাঞ্চলে পানি সরবরাহ করে চলেছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ১০ লাখ ৬২ হাজার কৃষক পরিবারের প্রায় ১০ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর রবি শস্যের জমিতে পানি সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার তাঁতইর গ্রামের বাাসিন্দা আব্দুল্লাহ (৩৮) বলেন, গভীর নলকুপ, সৌর শক্তি চালিত এলএলপি, খাস মজা খাল পুনঃখনন, খাবার পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ, ক্রসড্যাম, রাবার ড্যাম, ফিড রোড নির্মাণ, পাতকুয়া,বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বনায়নসহ বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করছে বিএমডিএ।
এদিকে গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়ার বাসিন্দা আতাউর রহমান (৫০) বলেন, মৌসুম শুরুর দিকে বিএমডিএ-এর পানি ব্যবহার করে কফি চাষ করে ভালো অর্থ উর্পাজন করেছি। আগে আমাদের এলাকায় বছরে একটি ফসল হতো। সেটাও বৃষ্টির পানিতে। একরে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান হতো। তবে যেবার বৃষ্টি সময়মতো হতো না সেবার কোনো ফসলে ঘরে আসতো না। এখন একরে ৮০ থেকে ৯০ মণ পর্যস্ত ধান হয়। কিছু কিছু জমিতে তিনটির বেশি ফসল হয়।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্থাপিত গভীর নলকূপের পানি গম, ধান, শাক-সবজি, আমের বাগানসহ সব ধরনের ফসল উৎপাদনের ব্যবহার হয়।
তানোরের বাধাইড় ইউনিয়নের (ইউপি)
কৃষক আব্দুর রহমান বলেন,গভীর নলকুপ তাদের কাছে আর্শীবদ হয়ে এসেছে।তিনি বলেন, তারা আগে আকাশের বৃষ্টিতে বছরে মাত্র একটি ফসল চাষাবাদ করতে পারতেন,সেটিও ঘরে তোলা নিয়ে ছিল চরম অনিশ্চয়তা।তবে গভীর নলকুপের কল্যানে তারা এখন সারা বছর জুড়েই চাষাবাদ করতে পারছেন।
অন্যদিকে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানিও সরবরাহ করছে এই বিএমডিএ। বিগত ১৯৯০ সালের আগেও মরুর মতো ছিল এলাকা। এখন সব পাল্টে সবুজে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৫ সালে পূর্বে লাল কংকরময় মাটির উঁচু-নিচু টিলা, ছায়াহীন এক রুক্ষ প্রান্তর বরেন্দ্র অঞ্চল।
বিএমডিএ জানায়, ড. মো. আসাদ উজ জামানের পরিচালনায় প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৫টি উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুকুর-খাল খননের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সৃষ্টি করা, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে মরু প্রক্রিয়া রোধ করা এবং উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করা ও যাতায়াতের জন্য ফিডার রোড নির্মাণ করা ছিল এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সময়ের স্বল্পতা, অর্থায়নের প্রতিকুলতাসহ নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতায় প্রকল্পের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, কিন্তু অল্প সংখ্যক হলেও উল্লেখিত কার্যক্রমসমূহ এ এলাকার মানুষের মনে বিরাট আশার আলো জাগায়। বরেন্দ্র এলাকার বিরানভূমিতে সোনালী ফসলের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে পরবর্তীতে সমগ্র বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়নের জন্য ১৯৯২ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সকল (২৫টি) উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে বিএমডিএ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এক হাজার ৮৯৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত। যাদের মধ্যে ১৯৪ জন সহকারী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী রয়েছে। এসব নিয়ে এগিয়ে চলেছে এক সময়ের বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি।
এবিষয়ে সেচ শাখার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, বিএমডিএ ১৬ জেলায় ১৫ হাজার ৮২৮টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। ১৫ হাজার ৮৯৫ দশমিক ০৬ কিলোমিটার এলাকায় সেচের পানি বিতরণ ব্যবস্থা নির্মাণ, পাতকূয়া ৬৫০টি; বিদ্যুৎ চালিত এলএলপি ৫৭৬টি ও সোলার এলএলপি ৪৫০টি। ৪ হাজার ২৫৭ কিলোমিটার খাস/মজা খাল পুনঃখনন, ৭৭৮টি ক্রসড্যাম নির্মাণ, ১৩টি নদীতে পল্টুন স্থাপন, ১৩ হাজার ০৫৭ হেক্টর জলাবদ্ধতা নিরসন- নওগাঁ জেলার রক্তদহ বিল, টেপাবিল, মনছুর বিল এবং রাজশাহী জেলার ছত্রগাছা বিল, দেবর বিল ইত্যাদি বিলের ৫৭২টি সোলার ডাগওয়েল নির্মাণ এবং এক হাজার ১৪৪ কিলোমিটার সংযোগ রাস্তা নির্মাণ করেছে। এই কর্মকর্তা আরো জানান, এক হাজার ৫৯২টি পরিবারের খাবারপানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ, বনায়নের লক্ষ্যে প্রায় ২ কোটি ৫৮ লাখ গাছ লাগানো, প্রতি বছর ৬০০ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন, এক লাখ ৪৮ হাজার ২১৮ কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আবাদযোগ্য জমি দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর এবং সেচকৃত জমি ১০ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর (আবাদযোগ্য জমির ৮৯ দশমিক ৩০ শতাংশ)। প্রায় ১০ লাখ ৬২ হাজার কৃষক পরিবার উপকৃত হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। গ্রামীন জনসাধারণের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য প্রামের বিভিন্ন স্থানে এক হাজার ৫৯২টি ওভারহেড ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে।
এবিষয়ে বিএমডিএ কুড়িগ্রাম নির্বাহী প্রকৌশলী (এক্সচেঞ্জ) ড, প্রকৌশলী মোঃ এজাদুল ইসলাম বলেন, কুড়িগ্রাম জেলার কৃষির উন্নয়নে বিএমডিএ অসমান্য অবদান রেখে চলেছে। তিনি বলেন, নদী ভাঙন ও খরা কবলিত এই অঞ্চলে কৃষির উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের ভাগ্যে ও জীবন মানোন্নয়নে নিররসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিএমডিএ।#