October 9, 2024, 6:31 pm
মোঃ হায়দার আলীঃ বিশ্ব নদী দিবস প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত একটি দিবস। সে অনুযায়ী এবছর ২২ সেপ্টেম্বর পালিত হয়েছে নদী দিবস। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে।
২২ সেপ্টেম্বর শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়েছে বিশ্ব নদী দিবস। বাংলাদেশের পাশাপাশি আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, কানাডা ও ব্রিটেনে নদী রক্ষায় নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয় এই দিনে। ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। দূষণের কারণে জলবায়ুতেও পরিবর্তন এসেছে যার কারণে অনেক নদী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব নদী দিবসে সাধারণ মানুষ এবং অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা নদী রক্ষার জন্য শপথ নেয় যে নদী দূষিত করবে না এবং দূষিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। বিশ্ব নদী দিবসে নদীর গুরুত্ব এবং নদীর পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। বিশ্বের অন্তত ৬০টি দেশে, বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে মানুষ উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে। এই দিন নদ-নদী পরিষ্কার, নদীতে র্যাফটিং-এর মতো কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
বিশ্ব নদী দিবসে । উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনার পরও রক্ষা হচ্ছে না উত্তরের নদীগুলো। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নামে সাবেক পতিত শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছেন। বাস্তবে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কমিশনে গাইফ করা হয়েছে। বর্তমানে এ পরিকল্পনা ফাইলের কোনো অস্তিত্বই নাই। নদী রক্ষার নামে গত ১৫ বছর দেয়া হয়েছিলো মিথ্যা আশ্বাস ও নিবাচনী প্রতিশ্রুতি। পদ্মা সেতু যে ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো ঠিক সেইভাবে নিজের টাকায়ই তিস্তার প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিলো। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্তে অনেক নদী থাকলেও স্বাধীনতার পর দু’দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছে কেবল গঙ্গা নদী ঘিরে। তিস্তা নদীকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে চীনের আগ্রহ ভারতের বড় বাঁধা কাটছে না।
ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে গত ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় বলা হয়েছে। মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দখল-দূষণ আর অপরিকল্পিত প্রকল্পে হত্যা করা হয়েছে উত্তাঞ্চলের শত শত নদীকে।
উত্তরাঞ্চলকে বাঁচিয়ে রেখেছে বিভিন্ন নদী। অর্থনীতিতে গতি দেয়া তিস্তাকে নানাভাবে দিল্লির দেয়ালে তিস্তা মহাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। শুকনা মৌসুমে মরা খাল আর বর্ষায় রাক্ষুসি করা হয়েছে নদীটিকে। এদিকে তিস্তা মহাপ্রকল্পের বাস্তবায়নে অন্তর্বকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস দিকে তাকিয়ে এখন তিস্তা পাড়ের লাখ লাখ মানুষ। তারা আশা করছেন জাতিসংঘ অধিবেশনে ড. ইউনূস তিস্তার পানির সুসম বণ্টন নিয়ে কথা বলবেন।
অর্ধশত বছরেও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেও পথ খুজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। তবে ভারতের তরফ থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া না মেলায় অনেকটাই নিষ্ফল হয়েছে সে প্রচেষ্টা। তিস্তা নদীর উজানে খাল ও ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তার প্রায় সবটুকু পানিই প্রত্যাহার করে আসছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনীয় সেচে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কৃষকরা। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পাহাড়ি ঢলের তোপের মুখে ভারত তার ব্যারেজগুলোর মুখ খুলে দেয়ায় সেখান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উত্তরাঞ্চল।
খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতিপ্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য। পাশাপাশি বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনাসহ নদীকে ঘিরে নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। চীনের এই আগ্রহে হঠাৎ করেই নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা নদী। এনিয়ে এখন সরগরম হয়ে উঠেছে রংপুরের রাজনীতি। পটভূমিতে নানা আয়োজনে ২২ সেপ্টেম্বর রোববার পালিত হয়েছে বিশ্ব নদী দিবস। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য ‘আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার।
এদিকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা অনেক পুরোনো। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরপরই ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি অন্তর্র্বতীকালীন চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী, তিস্তার পানির ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ ও ৩৯ শতাংশ ভারতের প্রাপ্য ছিল। অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তর্র্বতীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালে এর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি।
বারবার রংপুরবাসী ও তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে উপস্থিত হয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণার দাবি জানান সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি।
প্রতিবছর বন্যা এবং খরায় নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তিস্তার দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পারে একমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে তিস্তাপাড়ের মানুষের পানির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
প্রায় ২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে উত্তরের ২৫টি নদীর সঙ্গে প্রবাহ বইছে। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা,গাইবান্দার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদীশাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে।
গত ২০১৭ ইং সালে ভারী বর্ষণ ও উজানের পানিতে গঙ্গাচড়া উপজেলার এসকেএসের বাজার, পূর্ব ইচলী ও সিরাজুল মার্কেটের পাশ দিয়ে তিস্তা নদীর নতুন প্রবাহ তৈরি হয়। ওই বছর রেকর্ড পরিমাণ বন্যায় তিস্তার চর ও দ্বীপচর থেকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্পিডবোটে করে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে কুড়িগ্রাম রংপুরসহ অন্যান্য জেলার বন্যা পর্যবেক্ষণ করেন সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। তিস্তা খনন না হওয়ায় উজানের পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছর পলি পড়ছে। এতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। পরবর্তীতে বর্ষায় পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় নতুন নতুন দিক থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, অবকাঠামো নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে তিস্তার বামতীরে থাকা অধিবাসীরা তিস্তার কবল থেকে রক্ষা পেতে বাঁধের দাবি করে আসছে। এদিকে গত বছরের ৯ অক্টোবর রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পতিত সরকারের মন্ত্রীরাসহ আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিস্তাপারের মানুষের সঙ্গে কথা বলাসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি এসেছেন বলে সেই সময় চীনা রাষ্ট্রদূত জানান। সেই সঙ্গে তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের ইতিবাচক সাড়ার কথা ব্যক্ত করেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের তিস্তা এলাকা পরিদর্শন দেখে আশায় বুক বেঁধেছিল তিস্তাপারের মানুষ। কিন্তু ১৫ বছর পার হলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী রংপুরের পুত্রবধূ। ২০১১ থেকে ২০১২ সালের দিকে যখন ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি হলো না, তখন তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছিলেন। আমরা সেই সময় তিস্তাপারের লক্ষাধিক মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যে সেটি এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। রংপুর বিভাগে দরিদ্রতার হার সর্বোচ্চ আর বরাদ্দ সর্বনিম্ন। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অববাহিকার এক কোটি মানুষ উপকৃত হতো ।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে যুগের পর যুগ তিস্তাপারের মানুষকে খরা-বন্যা ও ভাঙনের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হবে। মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছে, বাড়ছে নদীশাসনের চ্যালেঞ্জ। অপরদিকে তিস্তার প্রবাহ ঠিক না থাকলে সাগরের লবণপানি লোকালয়ে উঠে আসবে। এতে ফসলী জমি নষ্ট হবে, জমি হারাবে উৎপাদন ক্ষমতা। তিনি আরও বলেন, ‘২০১১ সালের পর ২০২৪ সাল — মাঝখানে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করছে ভারত। ফলে পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের কাছে আশা জাগছে বটে; কিন্তু সে আশা যে খুব মধুর হবে, এটা মনে করি না।’
ভারত তিস্তা নদীর উজানে খাল ও ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার প্রায় সবটুকু পানিই প্রত্যাহার করে আসছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনীয় সেচে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পাহাড়ি ঢলের তোপের মুখে ভারত তার ব্যারেজগুলোর মুখ খুলে দেয়ায় সেখান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ। খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতিপ্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য। পাশাপাশি বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনাসহ নদীকে ঘিরে নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা জানায় বেইজিং। চীনের এই আগ্রহে হঠাৎ করেই নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা নদী। বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা নিয়ে আছে বিভ্রান্তি। স্বীকৃত নদীর সংখ্যা ৫৭ বলা হলেও গবেষকরা দাবি করেছেন, এর বাইরে আরও ৬৯টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে। আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে কোথাও এর স্বীকৃতি বা নথিভুক্তি নেই। নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া এবং স্বীকৃতি না মেলায় উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তিস্তা চুক্তি নিয়ে বলেন,
“নদীর পানি কেবলমাত্র রাজনীতি না, এটি কূটনীতি, অর্থনীতিও”
ফলে বাংলাদেশের ভাটি অংশে প্রয়োজনের সময় বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত হয় না। আবার অতিরিক্ত পানি সামলানোর নামে বর্ষা মৌসুমে বাঁধের কপাট খুলে দেওয়ায় ভাটি এলাকা বন্যায় ডোবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা নিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের নানা বাহানা উজানে থাকা বাংলাদেশকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় শান্তির জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক আস্থা থাকা জরুরি।
উজানের ঢলে প্রতিবছরই বাংলাদেশ আকস্মিক বন্যার মুখে পড়ে। কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী ও ফেনীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরী নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক ড্যাম তৈরি করেছে ভারত সরকার, সঙ্গে রয়েছে ব্যারাজ। এভাবে নদী অববাহিকার উপনদীগুলোতেও রয়েছে একাধিক বাঁধের অস্তিত্ব। প্রবল বর্ষণে নদী অববাহিকার উজানে পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ এই ড্যাম ও ব্যারাজ খুলে দিলে পানির প্রবল স্রোতে ভাটি অঞ্চল তলিয়ে যায়। অথচ এই বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়টি জানে না বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন। ৬৯ নদীর স্বীকৃতি নেই, চুক্তি শুধু গঙ্গা নিয়েই।
ভারত ও চীনের টানাটানিতেই যেন ঝুলে আছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এ মহাপরিকল্পনা ঘিরে চীন ও ভারতের মধ্যে চলছে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে গত ৪০ বছরে মূল প্রবাহের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে সরে গেছে তিস্তা। ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে বন্যা, ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি আর ঘরবাড়ী হারানো মানুষের সংখ্যা।
রংপুরের রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরেই ঝুলে থাকা প্রকল্পটির ইতি টানা জরুরি। এই নদী গবেষক বলেন, চীন কিংবা ভারত, অথবা দুই দেশ একসঙ্গে মহাপরিকল্পনা করুক। কিন্তু এই জুলাইয়ে পরিকল্পনা বিষয়ক সব ধোঁয়াশা দূর হওয়াটা জরুরি। অধিকার কর্মীদের মতে, চীন ও ভারত তিস্তা মহাপরিকল্পনায় কীভাবে সমন্বয় করবে সেটি দ্রুত পরিষ্কার করার সময় এসেছে। না হলে এই প্রকল্প ঘিরে যে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, সেটিতে আবার ভাটা পড়বে। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের রংপুর অঞ্চলের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ভারত কোন অংশে কাজ করবে এবং পুরো কাজ কীভাবে হবে তা কিন্তু এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার না। এই ধোঁয়াশা দূর হলে উত্তরের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে।
এদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ ৬ দফা দাবিতে তিস্তা সমাবেশের ডাক দিয়েছে ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’।
তিস্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজে রাজি চীন বলেন, ইয়াও ওয়েন
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আগ্রহ আছে চীনের। ২০২১ সালে তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে ২০২৩ সালের মার্চে বাংলাদেশকে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন জমা দেয়। দ্রুতই তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহ দেখায় তারা। বিনিয়োগেরও আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি। সবশেষ গত ৪ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে রাজি আছে চীন। যেকোনো সিদ্ধান্ত আমরা সম্মান করব। এ প্রকল্প নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা। এখনও আমরা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
অভিন্ন এই নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করায় পানির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ভারতের হাতে। গ্রীষ্ম ও শীতে বাঁধ বন্ধ থাকায় পানিশূন্যতা আর বর্ষায় বাঁধ উন্মুক্ত করে দিলে বন্যায় ভাসে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। তিস্তা বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত একটি নদী।
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। বহুকাল পর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথবৈঠকে তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুদেশের সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। তবে ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। তারা নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে নাম ঘোষণার পর বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সফর বাতিলের কারণ তিস্তা চুক্তিতে তার সায় না থাকা।
সেই ২০১১ থেকে ২০২৪। গেল প্রায় ১৩ বছর ধরে তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের অধিকার থাকলেও সেই পানির ন্যায্য ভাগও পায়নি ভাটির দেশের লাখ লাখ মানুষ। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল জলপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তায় আসতে দেয়া হলেও ২০১৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার জলপ্রবাহ বন্ধ করে দেয় ভারত।
বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি এড়িয়ে গিয়ে এবার নদী ব্যবস্থাপনার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশ মনে করছে এতে করে তিস্তার পানি সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হবে। কিন্তু স্থানীয় জনগন পানি ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় তিস্তা সমস্যা সমাধানে ভারতের নতুন প্রস্তাব ইতিবচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যখন ওই আলোচনা এবং সমঝোতা চলছে তখন তিস্তায় ভারত থেকে আসা পানির ঢলে বন্যা ও ভাঙনের শিকার হয়েছে রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। তিস্তার পানি নিয়ে উত্তরের জনপদের মানুষের দুর্ভোগ বহুমাত্রিক।
ভারতের মহাপরিকল্পনায় আগ্রহ থাকলেও দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক আরও দৃঢ় রাখতে এ চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা এখনই। তিস্তা-গঙ্গা-পদ্মা অভিন্ন নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে, এ কথাটি আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারিনা কেন ? আমাদের বলা উচিৎ নয় কি ?
লেখক: মোঃ হায়দার আলী,
গোদাগাড়ী উপজেলা শাখা,
রাজশাহী।