December 26, 2024, 12:50 pm
হাওড়া ব্রীজ এলাকা থেকে মোঃ হায়দার আলীঃ পুরনো হওড়া ব্রিজের নকশা বানিয়েছিলেন ব্র্যাডফোর্ড লেসলি। ব্রিটিশ শাসনে রেল কোম্পানির খ্যাতনামা কারিগর। ভারতের বহু বড় রেলসেতুর নকশা তিনিই বানিয়েছিলেন। যেমন, ব্যান্ডেল ও নৈহাটির মধ্যে জুবিলি ব্রিজ। কলকাতার একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক, হাওড়া ব্রিজ হুগলি নদীর উপর একটি বিশাল ইস্পাত সেতু। এটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্র সেতু নামেও পরিচিত, এটি হাওড়া এবং কলকাতাকে সংযুক্ত করে। এটি প্রতিদিন ১ লাখ যানবাহন এবং অগণিত পথচারী বহন করে। নাট-বোল্ট ছাড়াই ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই সেতু আজও কলকাতার গর্ব
কলকাতা প্রবেশ দ্বার বললে আজও সবাই হাওড়া ব্রিজকেই ধরে। কলকাতার গর্ব হাওড়া ব্রিজ। হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা এবং হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম। কলকাতার অতীত ইতিহাসের নানা গল্পের সাক্ষী হয়ে ইংরেজদের তৈরি হাওড়া ব্রিজ আজ আদ্যোপান্ত বাঙালি।
হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা এবং হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান বহির্বাহু সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে হয় রবীন্দ্র সেতু। রবীন্দ্র সেতু বঙ্গোপসাগরীয় প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করতে সক্ষম। এই সেতু দিয়ে দৈনিক ১ লাখ যানবাহন এবং প্রায় ১০ লক্ষ পথচারী চলাচল করেন। এই জাতীয় সেতুগুলির মধ্যে রবীন্দ্র সেতু বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম।
নিজেদের বাণিজ্যিক সুবিধার স্বার্থেই হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল ইংরেজরা। প্রথমে তা ব্যবহার করা হত বাণিজ্যিক কারণেই। মালবাহী গাড়ি যাতায়াত করত সেতু দিয়ে। সেই সময় গঙ্গা নদীতে জাহাজ স্টিমারের যানজট ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সমস্যা মেটাতেই গঙ্গার উপরে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। কলকাতার অতীত ইতিহাসের নানা গল্পের সাক্ষী হয়ে ইংরেজদের তৈরি হাওড়া ব্রিজ আজ আদ্যোপান্ত বাঙালি।
হাওড়া ব্রিজ হুগলি নদীর উপর অবস্থিত বড় খিলানযুক্ত একটি ঝুলন্ত সেতু। প্রথমে সেতুটির নাম ছিল নিউ হাওড়া ব্রিজ। কারণ আগে একই স্থানে অবস্থিত কলকাতা এবং হাওড়া জেলার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী একটি ভাসমান সেতু ছিল। সেই সেতুর পরিবর্তেই এই নতুন সেতু নির্মাণ করা হয়৷ নাম রাখা হয় নিউ হাওড়া ব্রিজ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে ১৯৬৫ সালে সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রবীন্দ্র সেতু। ( photo credit : unsplash.com)
ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ -সেতু নির্মাণের ভাবনা শুরু হয়েছিল সেই ইংরেজ আমলে। তখন সালটা ১৮৫৫-৫৬। সেতু নির্মাণের জন্য একটি কমিটিও তৈরি হয়। কারণ, তত দিনে গঙ্গার দুই পাড়েই জাঁকিয়ে বসে ইংরেজদের কারবার। তৈরি হয়েছিল নতুন নতুন কারখানা। তাই হাওড়া-কলকাতার জন্য একটি সেতুর দরকার পড়ে। সেতু কমিটিতে এই নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বছর চারেক পর ১৮৫৯-৬০ সালে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯ বছর পর বাস্তবায়ন- এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। অবশেষে সেতুর প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব বুঝে ১৮৭১ সালে তৈরি হয় একটি ট্রাস্ট। সেই ট্রাস্টের অধীনেই হাওড়ার প্রথম ভাসমান সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয়। নদীর ওপর ছিল পন্টুন ব্রিজ বা ভাসমান সেতু। নীচে নৌকা। উপরে পাটাতন। মাঝ বরাবর খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা। জাহাজ-স্টিমার চলাচলের জন্য সেতুর মাঝখানে ২০০ ফিট খুলে দেওয়া যেত। স্টিমার এলেই সেতু বন্ধ। ১৮৭৪ সালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেই সেতু। অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন যা পরিকল্পনা করেছিল, তা রূপায়িত হয় ১৯ বছর পর।
সাড়ে ২৩ হাজার টন ইস্পাতের ব্যবহার –
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সুবিশাল হাওড়া ব্রিজটি তৈরি করতে একটি নাট-বল্টু ব্যবহৃত হয়নি। ইস্পাতের পাত উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে জুড়ে এই সেতু তৈরি হয়েছে। সেতু নির্মাণে সাড়ে ২৩ হাজার টন ইস্পাত দিয়েছিল টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। এই সেতুই সম্ভবত ভারতের প্রথম মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্প।।কলকাতার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল হাওড়া ব্রিজ চত্বর। আদি কলকাতার স্বাদ পেতে গেলে একবার না একবার এই এলাকায় আপনাকে আসতেই হবে। ব্রিজের উপরে উঠে গঙ্গার দৃশ্য ভোলার নয়। হাওড়ার দিক থেকে হোক অথবা কলকাতার দিক থেকে, হাওড়া ব্রিজকেও দেখতে অসাধারণ লাগে। ইংরেজ আমলে তৈরি হলেও এই ব্রিজটি ভারতীয়ত্বের প্রতীক। ৭৫ বছর পেরিয়েও এটি দেশের অন্যতম পরিচিত একটি সৃষ্টি। হাওড়া ব্রিজ নিয়ে অজানা এই তথ্যগুলি সমস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীর জানা প্রয়োজন।
নাট-বোল্ট ছাড়া ব্রিজঃ
হাওড়া ব্রিজের মতো সুবিশাল ব্রিজ তৈরিতে একটিও নাট-বোল্ট লাগাতে হয়নি। মেটাল প্লেটগুলিকে এমনভাবে বসিয়ে চেপে দেওয়া হয়েছে যাতে কোনও নাট-বোল্ট ও স্ক্রু ছাড়াই এত বড় ব্রিজ সফলভাবে জুড়ে দেওয়া গিয়েছে।
ব্রিজের অভিনবত্ব
হাওড়া ব্রিজের ছবি ভালো করে দেখলে দেখবেন, কোনও পিলার বা স্তম্ভ ছাড়াই ব্রিজটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটিকে বলা হয় সাসপেন্ডেড-টাইপ ব্যালান্সড কান্টিলিভার ব্রিজ।
পুরানো ব্রিজঃনতুন ব্রিজটির বয়স সাত দশকের বেশি হয়ে গেলেও এটিকে নতুন হাওড়া ব্রিজ বলে ডাকা হয়। তার কারণ, এই জায়গায় আগে আর একটি ব্রিজ ছিল। তার নাম, পুন্টুন ব্রিজ। সেটি তৈরি হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। সেই ব্রিজের সীমিত ধারণ ক্ষমতা ছিল।
নতুন হাওড়া ব্রিজঃকলকাতা, সুতানূটি ও গোবিন্দপুর নিয়ে তৈরি কলকাতা তখন ঝড়ের গতিতে কলেবরে বাড়ছে। অন্যদিকে হাওড়া হল কমার্শিয়াল হাব। দুটি গঙ্গাপাড়ের এলাকাকে জুড়ে দেওয়ার আশু প্রয়োজন ছিল। ১৯০৬ সালে হাওড়া স্টেশন তৈরি হওয়ার পরে সেই চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তাই নতুন ব্রিজ তৈরির জন্য পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কাঃ উনিশ শতকের শেষদিকে পুরনো পুন্টুন ব্রিজ সরিয়ে নতুন ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব সামনে আসে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে তা থেমে যায়। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পুরনো পুন্টুন ব্রিজ সারাই হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৪৩ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজের পথ চলা শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধের কারণে বারবার থমকে গিয়েছিল ব্রিজ তৈরির কাজ।
কোনও উদ্বোধন হয়নিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝেই ১৯৪২ সালে হাওড়া ব্রিজ তৈরির কাজ শেষ হয়েছিল। এবং ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিজটি জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে এই বিষয়টিকে সারা বিশ্বের সামনে গোপন রাখা হয়েছিল। কারণ ইতিমধ্যে জাপান পার্ল হারবারে বোমা ফেলেছিল। এই ব্রিজের কথা জানলে যদি এটিকেও টার্গেট করা হয়, সেই ভেবেই ঘটা করে উদ্বোধন না করে ব্রিজটি খুলে দেওয়া হয়।
ভারতের অবদান-ব্রিটিশ ভারতে কোনও কিছু তৈরি করতে হলে শুধু কাঁচামাল নয়, পুরো তৈরি প্রোডাক্টই জাহাজে চাপিয়ে ভারতে আনা হতো। তারপর এখানে এনে জুড়ে দেওয়া হতো। ব্রিজের সরঞ্জাম ইংল্যান্ড থেকে কলকাতা আসার কথা ছিল। সেজন্য প্রয়োজন ছিল ২৬ হাজার টন স্টিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলায় সেই জাহাজ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। মাত্র তিন হাজার টন কাঁচামাল ইংল্যান্ড থেকে সাপ্লাই হয়েছিল। বাকী ২৩ হাজার টন কাঁচামাল বা স্টিল সরবরাহ করেছিল ভারতের টাটা স্টিল কোম্পানি। এমনকী নতুন ব্রিজ তৈরির সময়ে স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যেই কাজ হয়েছিল।
ট্রাম চলাচলঃ হাওড়া ব্রিজে প্রতিদিন লাখো লোক হেঁটে অথবা গাড়ি-বাসে যাতায়াত করেন। তবে ব্রিজ তৈরি হওয়ার পর প্রথম যুগে কলকাতা ও হাওড়ার দুদিক থেকেই লোককে পার করার জন্য ট্রাম ব্রিজের উপরে চলাচল করত। বস্তুত, প্রথম যে গাড়িটি ব্রিজে চলেছিল সেটি ট্রামই ছিল। তবে বাড়তে থাকা ট্রাফিকের চাপে ১৯৯৩ সালে ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হাওড়া ব্রিজের রেকর্ডঃ যখন তৈরি হয় তখন এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম ছিল। বর্তমানে এটি বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম কান্টিলিভার ব্রিজ। দৈর্ঘ্যে ব্রিজটি ৭০৫ মিটার লম্বা ও চওড়ায় ৭১ ফুট। সঙ্গে পথচারীদের জন্য ১৪ ফুট চওড়া ফুটপাথ দুদিকে।
রবীন্দ্র সেতঃ ভারতের সমস্ত এলাকা ও সৌধের নাম কোনও না কোনও বিখ্যাত মানুষের নামে দেওয়া। ১৯৬৫ সালে এই সেতুর নামকরণ করা হয় রবীন্দ্র সেতু নামে। তবে সেই নামকে ছাপিয়ে হাওড়া ব্রিজই লোকের মুখে মুখে ঘোরে।
সবচেয়ে ব্যস্ততম ব্রিজঃ হাওড়া ব্রিজ সম্ভবত বিশ্বের ব্যস্ততম কান্টিলিভার ব্রিজ। দিনে ১ লক্ষ গাড়ি-ঘোড়া ও দেড় লক্ষ মানুষ হেঁটে এই ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। ১৯৪৬ সালে দিনে ২৭ হাজার গাড়ি, ১ লক্ষ ২১ হাজার পথচারী ও ৩ হাজার গরুর গাড়ি নবনির্মিত হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করত।
জানেন পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে ভারতের সবথেকে বেশি প্লাটফর্ম যুক্ত স্টেশন?
বহু ঘটনার সাক্ষী হাওড়া ব্রিজ কেমন আছে? খোঁজ নেবে আইআইটি চেন্নাই
দিলীপের মিছিল আটকাতে ধুন্ধুমার কাণ্ড! পুলিশের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ
মোঃ হায়দার আলী
হাওড়া ব্রিজ। ভারত থেকে।