September 27, 2023, 7:26 am
মোঃ হায়দার আলীঃ কাঁচা মরিচে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। ১০০ গ্রাম মরিচে ১২৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি রয়েছে । তাছাড়া মরিচে নানা রকম পুষ্টিগুন যেমনঃ ১ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৭ গ্রাম আঁশ,১০৩ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২ গ্রাম আমিষ, ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২ মিলিগ্রাম লৌহ, ২৩৪০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন, ভিটামিন বি-২ ও ২৪ গ্রাম শর্করা ইত্যাদি রয়েছে।
কাঁচা মরিচের ভেষজ গুণ ও উপকারিতা কাঁচা মরিচ এক প্রকারের ফল যা মসলা হিসাবে ঝাল স্বাদের জন্য রান্নায় ব্যবহার করা হয়। শুধু যে খাবার সুস্বাদু করে তা নয়, এই মরিচে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ।
পুষ্টিগুণ: কাঁচা মরিচে রয়েছে প্রচুর ডায়াটারি ফাইবার, সোডিয়াম, থিয়ামিন, রাইবোফ্লবিন, নিয়াসিন, ফলেট, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন এ, সি, কে, বি৬, পটাসিয়াম, কপার এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো উপাদান যা নানাভাবে শরীরের উপকারে লাগে থাকে।
ভেষজ গুণ: নিয়মিতভাবে কাঁচা মরিচ খেলে মুখে ‘ঘা’ হয় না।
ব্যবহার: রান্না-বান্না ও মুখরোচক খাবার তৈরি ছাড়াও মরিচ বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়। অনেকে মরিচের আচারও করে থাকেন।
উপকারিতা:
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে: প্রতিদিন অন্তত দু’টি কাঁচা মরিচ খেলে কোনো রোগই কাছে ঘেঁষতে সাহস পাবে না। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এতটাই শক্তিশালী করে তোলে যে কোনো রোগ-জীবাণুই শরীরের ক্ষতি করে উঠতে পারে না। ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শুধু ইমিউনিটি বাড়ায় না, সেইসঙ্গে দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটাতে এবং ত্বককে সুন্দর করে তুলতেও সাহায্য করে।
হজমে কাজ করে: হজমের সমস্যায় খেতে পারেন কাঁচা মরিচ। খুব তেল-মসলার রান্নায় ঝালের পরিমাণ কমিয়ে দিন। হালকা ঝাল হজমে সাহায্য করে।
খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়: কাঁচা মরিচ শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। মরিচের বীজ এ কাজে খুবই কার্যকর। তাই উচ্চরক্তচাপ ও কোলেস্টেরলে ভুগতে থাকা রোগীদের পাতে মরিচ রাখুন।
ডায়াবেটিস দূরে রাখে: কাঁচা মরিচের বিভিন্ন উপকারী উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডায়াবেটিসের মতো রোগ ধারে কাছে ঘেঁষার সুযোগই পায় না। হার্ট চাঙ্গা থাকে: নিয়মিত দু’টি করে কাঁচা মরিচ খেলে হার্টের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এতে থাকা বেশকিছু উপকারী উপাদান একদিকে যেমন রক্তে উপস্থিত খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে ফেলে, তেমনি ট্রাইগ্লিসারাইড যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখে। শুধু তাই নয়, কোনোভাবেই যাতে ব্লাড ক্লট না হয়, তাও সুনিশ্চিত করে এই প্রাকৃতিক উপাদানটি। ফলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস ও হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা যায় কমে।
সাইনাসের কষ্ট কমে: কাঁচা মরিচে রয়েছে ক্যাপসিসিন নামক একটি উপাদান, যা ঝাল স্বাদের জন্য দায়ী। এই ক্যাপসিসিন কিন্তু শরীরের নানাবিধ উপকারেও লাগে। যেমন- এই উপাদানটি শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মিউকাস মেমব্রেনের মধ্যে রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে সাইনাস ইনফেকশনের প্রকোপ কমতে সময় লাগে না।
ক্যান্সার দূরে রাখে: কাঁচা মরিচে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানের সব বেরিয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যান্সার সেল জন্ম নেয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
স্ট্রেস কমে: মন খারাপ হলে দ্রুত একটি কাঁচা মরিচ খেয়ে ফেলুন। দেখবেন মন-মেজাজ একেবারে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এই প্রাকৃতিক উপাদানটি খাওয়া মাত্র এন্ডোরফিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। ফলে স্ট্রেস লেভেল তো কমেই, সেই সঙ্গে মন আনন্দে ভরে ওঠে।
এখন বলতে ইচ্ছা করছে, সবার উপরে মরিচ দামি তাহার উপরে নাই’। সত্যিই মরিচের উপর দামি পণ্য আর যেনো কিছু নেই। টেলিভিশন, পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাঁচা মরিচের কেজি ৯০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ, নিন্দা, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জোরালো হয়েছে। আবার কয়েক দিনের কাঁচা মরিচের দাম অব্যাহতভাবে নিন্মমুখী হচ্ছে। বাঙালির রসুঁই ঘরে এখন সবচেয়ে দামি মশলা জাতীয় সবজি কাঁচা মরিচ। সবুজ রঙের মরিচ এখন সর্বচ্চ মর্যাদায় উঠে গেছে। রসুঁই ঘরে কাঁচা মরিচ এখন রান্নার অন্যান্য উপকরণ পেঁয়াজ, রসুন, লবণ, আদাকে উপহাস করছে। ছিঁ, ছিঁ তোমরা এতো নীচ! বাস্তবতা হচ্ছে রাজধানী ঢাকার ফ্ল্যাট বাসা থেকে শুরু করে সারাদেশের গ্রামেগঞ্জের ঘরে ঘরে কাঁচা মরিচ নিয়ে আলোচনা। হাটে বাজারে আলোচনার প্রধান বিষয় কাঁচা মরিচের দাম। একবার পেঁয়াজের মূল্য ৩ শ থেকে সাড়ে ৩ শ টাকা কেজি,ডিম সিন্ডিকেট’ ‘ব্রয়লার মুরগি সিন্ডিকেট’ ‘চাল সিন্ডিকেট’, ‘সয়াবিন তেল সিন্ডিকেট’ করে ওই সময় ওইসব দ্রব্যের মূল্য নিয়ে একই অবস্থা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ডিপ্লোমেটের প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ’ এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড, এস জয়শঙ্করের বক্তব্য ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সব দলের সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা ভারত আয়ত্ত করেছে’ আমেরিকা ভিসানীতি নিয়ে এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সর্বোত্রই এই দুটি তৎপর্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক, মন্তব্য, মতামত, আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে নেটিজেনরা নানান মন্তব্য-বক্তব্য দিচ্ছেন।
এই মন্তব্য-বক্তব্য-আলোচনাকে ছাড়িয়ে গেছে কাঁচা মরিচ। কেউ লিখেছেন, কাঁচা মরিচের নতুন নামকরণ হচ্ছে ‘হাজারি মরিচ’ কেউ লিখেছেন, বাজারে গিয়ে ‘৫০ গ্রাম টিপু মুনশি’ দেন বললেই দোকানি কাঁচা মরিচ দেবে। উল্লেখ, ১৯৭৪ সালে লবনের সের ৮০ টাকা হওয়ায় তখন অনেকেই বলতেন (এক ছটাক আমু দেন; এরশাদের শাসনামলে ‘চিনি জাফর’ শব্দটি ব্যাপক ব্যবহৃত হতো), কেউ লিখেছেন কাঁচা মরিচ রসুঁই ঘরে উচ্চাসনে বসেছে, কেউ লিখেছেন, কাঁচা মরিচের ভেজসগুণ বুঝতে পেরে এতোদিনে কাঁচা মরিচের মূল্যায়ন হয়েছে, আবার কেউ লিখেছেন বিয়ে অনুষ্ঠানে এখন ‘কাঁচা মরিচ’ হতে পারে সবচেয়ে উকপারি উপহার। নানান বক্তব্য-মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা। প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে কাঁচা মরিচ ‘ভিভিআইপি’ মর্যাদায় উঠলো কেন?
এখন কার নিয়ন্ত্রণে কাঁচা মরিচের বাজার? কোন সিন্ডিকেটের কবলে কাঁচা মরিচ চলে গেছে? এর আগেও ‘ডিম সিন্ডিকেট’ ‘ব্রয়লার মুরগি সিন্ডিকেট’ ‘চাল সিন্ডিকেট’, ‘পেঁয়াজ সিন্ডিকেট’ ‘সয়াবিন তেল সিন্ডিকেট’ করে বাজার কৃতিম সংকট তৈরির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া হয়েছে। এক সাপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নিয়েও স্বীকার করে বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিপদ হবে। সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে।
এটা ঠিক বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার আমরা সিন্ডিকেট হোতাদের জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম; সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটাও তো সইতে আমাদের কষ্ট হবে।’ বাণিজ্য মন্ত্রীর এই অসহায়ত্ব প্রমাণ করে সরকারের হাতের চেয়ে সিন্ডিকেটের হাত অনেক লম্বা; সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে গেছে প্রশাসনযন্ত্র। অবশ্য সংসদের ওই অধিবেশনে কয়েকজন সংসদ সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত অভিযোগ করেছেন। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী স্বীকার করলেও সিন্ডিকেটে তিনি নেই বলে জানান।
পত্রিকা পড়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহে কাঁচা মরিচ ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। রংপুরে ৮০০ টাকা, কুড়িগ্রামে ৭০০ টাকা, রাজধানী ঢাকার বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ মানভেদে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের আঁতুড় ঘর খ্যাত পাবনায় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে।
এ অবস্থায় সরকার ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর দাবি করা হচ্ছে আষাঢ় মাসে বৃষ্টির কারণে জমিতে মরিচের গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে গেছে। বাস্তবতা কি তাই বলে? ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। প্রতিবছর এই দুই মাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে। জমি ভেজা থাকায় মরিচের গাছের ক্ষতি হয়। তবে কোনো বছরেই বৃষ্টির কারণে কাঁচা মরিচের কেজি ২০০ টাকার বেশি হয়নি। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি নিয়ে লতা মঙ্গেশকারের কালজীয় গান ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন/ ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে’। এই দুই মাসে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় এমন গান রচিত হয়েছে। অথচ এখন তেমন বৃষ্টি হয় না। চলতি বছর বৃষ্টি খুব কম হয়েছে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়ে যে পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা তার অর্ধেক পরিমাণ বৃষ্টিও হয়নি। ফলে বৃষ্টির কারণে মরিচের দাম বেড়েছে এটা যুক্তিতে খাটে না।
হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের আকাশছোঁয়া দাম হলো কেন? কেন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেল কাঁচা মরিচ? নাকি ডিম, ব্রয়লার, পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের মতো সিন্ডিকেট করে কাঁচা মরিচ সংকটের সৃষ্টি করে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার ফন্দিফিকির করা হয়েছে? জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে সরকার কর্পোরেট হাউজ সিন্ডিটের কাছে অসহায়।
তরকারি তথা খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে লবণ-রসুন-পেঁয়াজের মতোই কাঁচা মরিচ ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতিদিনের পান্থা ভাত, সকালের নাস্তা, পোলাও-বিরিয়নি, মাছ, গোশত, সবজি যেকোন ঝাল রান্নায় কাঁচা মরিচের ব্যবহার হয়ে থাকে। ইদানিং কুমিল্লার মাতৃভাইয়ের রসমালাইয়ের পাশাপাশি ছানার সঙ্গে কাঁচা মরিচ পিষিয়ে পেস্ট করে মিশিয়ে ঝাল রসগোল্লা বানানো হচ্ছে। রসগোল্লায় সবুজ মরিচের ব্যবহার হওয়ায় কি কাঁচা মরিচের চাহিদা বেড়ে গেছে? সেটা হলে তো শুধু কুমিল্লায় ও রাজশাহীতে দাম বাড়ার কথা। এছাড়াও কাঁচা মরিচের নাকি ওষুধিগুন আবিষ্কৃত হয়েছে।
ভেজস চিকিৎসকরা বলে থাকেন সবুজ কাঁচা মরিচে আছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, যা মানুষের শরীরের জন্য খুব উপকারি। কাঁচা মরিচ সাধারণত কাঁচা, রান্না কিংবা বিভিন্ন ভাজিতে দিয়ে খাওয়া হয়। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, বি-৬, আয়রন, পটাশিয়াম এবং খুবই সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট। ঝাল স্বাদের সবজির তরকারিতে থাকে বিটা ক্যারোটিন ও আলফা ক্যারোটিন, বিটা ক্রিপ্টোক্সানথিন ও লুটেইন জিয়াক্সানথিন ইত্যাদি উপাদান। এই উপাদানগুলো মুখে লালা আনে ফলে খেতে মজা লাগে। এছাড়াও এগুলো মহিলাদের ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। কাঁচা মরিচের স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে ভেজস চিকিৎসকরা দাওয়াই দিয়ে থাকেন। সে জন্যই হয়তো কাঁচা মরিচের দাম এখন আকাশচুম্বি। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতায় দেশের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। সময়ে সময়ে একেকটা পণ্যে দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় ওই সব পণ্য ক্রয়ে মানুষকে চরম বিপাকে পড়তে হয়। অথচ দায়িত্বশীলরা সায়দারা বক্তব্য ‘সিন্ডিকেট’ ‘সিন্ডিকেট’ আমদানি করা হবে, ইত্যাদি বলে জনগণকে ধোকা দেন। এর মধ্যেই সিন্ডিকেটের হোতারা শত শত কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে তুলে নিয়ে যান। প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে আর কতদিন চলবে? কথায় আছে সিন্ডিকেটের হাত যত বড় হোক না কেন; সরকারের হাত তার চেয়ে লম্বা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের হাতের চেয়ে সিন্ডিকেটের হাত লম্বা হবে কেন? বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটাই প্রমাণ করে। তাহলে কি জাতীয় সংসদে অন্যান্য এমপিরা যে অভিযোগ তুলেছেন সিন্ডিকেটে মন্ত্রীরা জড়িত সেটাই সত্য? দেশের ভোক্তারা কাঁচা মরিচের ভিভিআইপি মর্যাদা চায় না। চায় ক্রয় ক্ষমতার মধ্য দামের নিয়ন্ত্রণ।
পেঁয়াজের পর এবার কাঁচামরিচ নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি চলছে। কুরবানির ঈদের আগ থেকেই বাড়ানো হচ্ছে দাম। পরিস্থিতি এমন, রাজধানীতে প্রতিকেজি ৬০০-৮০০ টাকা বিক্রি হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খুচরা পর্যায়ে ৭০০-৮০০ টাকা এমনকি কোথাও কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ১২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়তে বাড়তে কোরবানির ঈদের আগের দিন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা কেজিতেও কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। ফলে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে কাঁচা মরিচ কিনতেও ক্রেতারা নাজেহাল হচ্ছেন।
রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা এই সিন্ডিকেট চাচ্ছে কিছু দিন সিন্ডিকেট করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে আবার আমদানি করে দাম কমানো। মাঝে হয়ে যাচ্ছে বড় অঙ্কের বাণিজ্য। দাম বাড়িয়ে আমদানিই ওই সিন্ডিকেটের লক্ষ্য বলে সূত্র জানিয়েছে। এরপরও দাম কমছে না। আর আকাশ ছোঁয়া দাম বৃদ্ধির রহস্য খুঁজে পাচ্ছে না সরকারের সংশ্লিষ্টরা। সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, ঈদ ঘিরে এটি সিন্ডিকেটের কারসাজি। চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের পর এবার কাঁচামরিচের বাজারেও সিন্ডিকেট থাবা বাসিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি বলেছেন, কাঁচামরিচ কৃষিজাত পণ্য। এর দাম কেন বাড়ল তা কৃষি মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এটা আমাদের ব্যাপার নয়। অবশ্য মরিচের ঊর্ধ্বমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ২৫ জুন থেকে মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে দুদিন আমদানির পর ঈদের কারণে আপাতত বন্ধ ছিল মরিচ আমদানি। ছুটি শেষে বন্দরগুলো চালু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আবারও দেশে আসতে শুরু করেছে আমদানিকৃত কাঁচা মরিচ। যদিও ঈদের টানা ৫ দিন ছুটির পর সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে শুরু হয়েছে আমদানি রফতানি কার্যক্রম। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম গতকাল অমদানির সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, দেশে এ পর্যন্ত মোট ৯৩ টন মরিচ আমদানি করা হয়েছে। কেবল গত রোববারই (বিকেল ৫টা পর্যন্ত) ৫৫ টন মরিচ দেশে এসেছে। এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৮৩০ টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন জেলার মরিচচাষি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এপ্রিল ও মে মাসে খরার পর হঠাৎ অতিবৃষ্টিতে বেশির ভাগ মরিচগাছ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে অধিকাংশ গাছে ফলন নেই বললেই চলে। এর ওপর টানা বৃষ্টিতে মরিচ সংগ্রহের কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সরবরাহ ঘাটতিতে অধিকাংশ জায়গায় কাঁচা মরিচের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। তকে কোন অজুহাতেই দাম এতোটা বাড়ার সুযোগ নেই বলে মনে তরছে ক্যাব। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের মনে করেন, এত কিছু সত্ত্বেও কাঁচা মরিচের কেজি ৭০০-৮০০ টাকা হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
এখানে অবশ্যই সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। এর আগে পেঁয়াজসহ অন্য নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা দেখেছি। সূত্র মতে, ঈদের আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। এতে দ্রুত কাঁচা মরিচের দাম কমে আসবে বলে ধারণা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারের সেই উদ্যোগের সুফল এখনো মেলেনি। কারণ কয়েক ট্রাক কাঁচা মরিচ আমদানি করে একটি জেলাও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই আগে অসাধু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিজেদের মুনাফালোভী মনোভাব পরিহার করতে হবে।
ঈদের চতুর্থ দিন দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতি কেজি কাঁচামরিচ সর্বোচ্চ ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ ঈদের আগের দিনও এর দাম ছিল সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলা কাঁচা মরিচ উৎপাদনের এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানেও গতকাল পাইকারিতে প্রতি কেজি মরিচের দাম ৬০০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে দাম ছিল ৭০০ টাকার বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় বলেন, বর্ষায় মরিচের জমি ডুবে গেছে। চরাঞ্চলের জমিও ডুবে গেছে। ঈদের মধ্যে চাহিদা বেড়েছে। তবে এত দাম বৃদ্ধির রহস্য খুঁজে পাচ্ছি না। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি হচ্ছে। আশা করি দ্রুত কাঁচা মরিচের দাম কমবে।
দেশে প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ার পর, সরকার ভারত থেকে কাঁচামরিচ আমদানির অনুমতি প্রদান করেন। এর পরই গতকাল বিকেলে থেকে বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হয়েছে। আমদানি অব্যাহত থাকলে কাঁচামরিচের ঝাঁজ কমবে বলে সাধারণ মানুষ আশা করছেন। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যের প্রতিবেদনে-
বেনাপোল বন্দর দিয়ে এই প্রথম গত রোববার বিকেলে ভারত থেকে ৫টি ট্রাকে করে ৩৪ মে. টন কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে। দেশে প্রতিকেজি মরিচ ১হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ার পর, সরকার ভারত থেকে কাঁচামরিচ আমদানির অনুমতি প্রদান করেন।
এর পরই গতকাল বিকেলে থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হয়েছে। বিকাল ৫টার মধ্যে ৫ ট্রাকে করে প্রায় ৩৪ মেট্রিক টন ভারতীয় কাঁচা মরিচ বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে।
কাঁচা মরিচের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বেনাপোলের “মেসার্স উষা ট্রেডিং, এন এস এন্টারপ্রাইজ ও এস এম করপোরেশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাঁচামরিচ আমদানির জন্য অনুমতিপত্র (আইপি) পেয়েছে। শুধুমাত্র এসব অনুমতি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি করবে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স উষা ট্রেডিং এর স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, “দেশে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভারত থেকে আমদানি কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২৫ জুন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে (খামারবাড়ী) কাঁচা মরিচ আমদানির জন্য আইপি প্রদান করেন।
বেনাপোল স্থলবন্দর উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কর্মকর্তা হেমন্ত কুমার সরকার বলেন, দেশের বাজারে ঈদের আগে থেকে হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেয়ায় আমদানি শুরু হয়েছে।
বেনাপোল কাস্টমস এর ডেপুটি কমিশনার তানভীর আহমেদ বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ০.৫০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করে খালাশ প্রদান করছেন। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজির মূল্য ৩২.২০ টাকা পড়ে। মোট শুল্ক হার ৫৮.৬০%। কাঁচা মরিচ বন্দর থেকে দ্রুত খালাশ দেয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা দিয়ে ভারত থেকে ৬ ট্রাক কাঁচা মরিচ এসেছে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে। গত রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বন্দর দিয়ে কাঁচা মরিচ বোঝাই ট্রাকগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ট্রাকগুলোতে ৭২ টনের মতো কাঁচা মরিচ রয়েছে বলে জানা গেছে।
ভোমরা বন্দরের আমদানি-রফতানি কারক আশরাফুল রহমান জানান, ৬ ট্রাক ভর্তি কাঁচা মরিচ ভারত থেকে ভোমরা স্থলবন্দরে পৌঁছালেও নানান জটিলতায় তা বাংলাদেশি ট্রাকে আনলোড করতে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, ঈদের ছুটি শেষে প্রথম অফিস দিনে কাস্টমসের অনেক কর্মকর্তা না আসায় এই জটিলতায় পড়েছেন কাঁচা মরিচ আমদানি কারকরা। বিল অব এন্ট্রি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রমে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, তার আমদানিকৃত কয়েকটির মধ্যে একটি ট্রাক আনলোড হচ্ছে। বাকিগুলো অফিস সঙ্কটে আটকে রয়েছে। পচনশীল পণ্য এই কাঁচা মরিচ দ্রুত আনলোড করে বাজারে সরবরাহ করা জরুরি।
ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ৬ ট্রাক এসেছে। ভারতীয় পারে আরো বেশকিছু কাঁচা মরিচ বোঝাই ট্রাক অবস্থান করছে। সন্ধ্যার আগে সেগুলো বন্দরে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির খবরে পাইকারী ও খুচরা বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। দাম কমায় স্বস্তি ফিরেছে ক্রেতা সাধারণের মাঝে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চার ট্রাকে ৩৭ দশমিক ৯৪ টন কাঁচা মরিচ প্রবেশ করেছে। এই স্থলবন্দর দিয়ে কাঁচা মরিচ আমদানির ছয় দিন পর সোমবার (৩ জুলাই) দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই ট্রাকগুলো প্রবেশ করে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার প্রভাত কুমার সিংহ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পানামা সোনামসজিদ পোর্ট লিংক লিমিটেডের পোর্ট ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, দুপুর থেকে কাঁচা মরিচ আসা শুরু হয়েছে সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মরিচভর্তি চারটি ট্রাক পানামায় প্রবেশ করেছে। এর আগে সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে সর্বশেষ গত ২৬ জুন এক ট্রাক কাঁচা মরিচ আমদানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
পেঁয়াজের পর এবার কাঁচামরিচ নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি চলছে। কুরবানির ঈদের আগ থেকেই বাড়ানো হচ্ছে দাম। পরিস্থিতি এমন, রাজধানীতে প্রতিকেজি ৬০০-৮০০ টাকা বিক্রি হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খুচরা পর্যায়ে ৭০০-৮০০ টাকা এমনকি কোথাও কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ১২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়তে বাড়তে কোরবানির ঈদের আগের দিন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা কেজিতেও কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। ফলে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে কাঁচা মরিচ কিনতেও ক্রেতারা নাজেহাল হচ্ছেন। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে খেতের মরিচ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঈদের ছুটিতে সরবরাহ ঘাটতির কারণে মরিচের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে সেটি এভাবে অস্বাভাবিক হওয়ার কারণ নেই। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছেন, প্রতিবছরই এই সময়ে বন্যা-বর্ষার কারণে মরিচের কিছুটা ঘাটতি হয়। তবে দাম দু’এক দিনের জন্য বাড়লেও সাধ্যের মধ্যেও থাকে। কিন্তু এ বছরই ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে কাজ করেছে বড় একটি সিন্ডকেট। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা এই সিন্ডিকেট চাচ্ছে কিছু দিন সিন্ডিকেট করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে আবার আমদানি করে দাম কমানো। মাঝে হয়ে যাচ্ছে বড় অঙ্কের বাণিজ্য। দাম বাড়িয়ে আমদানিই ওই সিন্ডিকেটের লক্ষ্য বলে সূত্র জানিয়েছে। এরপরও দাম কমছে না। আর আকাশ ছোঁয়া দাম বৃদ্ধির রহস্য খুঁজে পাচ্ছে না সরকারের সংশ্লিষ্টরা। সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, ঈদ ঘিরে এটি সিন্ডিকেটের কারসাজি। চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের পর এবার কাঁচামরিচের বাজারেও সিন্ডিকেট থাবা বাসিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি বলেছেন, কাঁচামরিচ কৃষিজাত পণ্য। এর দাম কেন বাড়ল তা কৃষি মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এটা আমাদের ব্যাপার নয়। অবশ্য মরিচের ঊর্ধ্বমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ২৫ জুন থেকে মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে দুদিন আমদানির পর ঈদের কারণে আপাতত বন্ধ ছিল মরিচ আমদানি। ছুটি শেষে বন্দরগুলো চালু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আবারও দেশে আসতে শুরু করেছে আমদানিকৃত কাঁচা মরিচ। যদিও ঈদের টানা ৫দিন ছুটির পর সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে শুরু হয়েছে আমদানি রফতানি কার্যক্রম। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম গতকাল অমদানির সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, দেশে এ পর্যন্ত মোট ৯৩ টন মরিচ আমদানি করা হয়েছে। কেবল গতকাল রোববারই (বিকেল ৫টা পর্যন্ত) ৫৫ টন মরিচ দেশে এসেছে। এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৮৩০ টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন জেলার মরিচচাষি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এপ্রিল ও মে মাসে খরার পর হঠাৎ অতিবৃষ্টিতে বেশির ভাগ মরিচগাছ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে অধিকাংশ গাছে ফলন নেই বললেই চলে। এর ওপর টানা বৃষ্টিতে মরিচ সংগ্রহের কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সরবরাহ ঘাটতিতে অধিকাংশ জায়গায় কাঁচা মরিচের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। তকে কোন অজুহাতেই দাম এতোটা বাড়ার সুযোগ নেই বলে মনে তরছে ক্যাব। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের মনে করেন, এত কিছু সত্ত্বেও কাঁচা মরিচের কেজি ৭০০-৮০০ টাকা হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এখানে অবশ্যই সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। এর আগে পেঁয়াজসহ অন্য নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা দেখেছি।
ঈদের আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। এতে দ্রুত কাঁচা মরিচের দাম কমে আসবে বলে ধারণা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারের সেই উদ্যোগের সুফল এখনো মেলেনি। কারণ কয়েক ট্রাক কাঁচা মরিচ আমদানি করে একটি জেলাও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই আগে অসাধু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিজেদের মুনাফালোভী মনোভাব পরিহার করতে হবে। ঈদের চতুর্থ দিন গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতি কেজি কাঁচামরিচ সর্বোচ্চ ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ ঈদের আগের দিনও এর দাম ছিল সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলা কাঁচা মরিচ উৎপাদনের এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানেও গতকাল পাইকারিতে প্রতি কেজি মরিচের দাম ৬০০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে দাম ছিল ৭০০ টাকার বেশি।
তবে বিক্রেতারা বলছেন, ঈদের ছুটির পর বিভিন্ন জেলা থেকে মরিচ আসতে শুরু করেছে। এতে কমছে দাম। এ ছাড়া ভারত থেকে মরিচ এলে দাম আরও কমবে। শিশির নামে এক বিক্রেতা বলেন, বাজারে এখন প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। কেজিতে কমেছে ১০০ টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় বলেন, বর্ষায় মরিচের জমি ডুবে গেছে। চরাঞ্চলের জমিও ডুবে গেছে। ঈদের মধ্যে চাহিদা বেড়েছে। তবে এত দাম বৃদ্ধির রহস্য খুঁজে পাচ্ছি না। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি হচ্ছে। আশা করি দ্রুত কাঁচা মরিচের দাম কমবে।
দেশে প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ার পর, সরকার ভারত থেকে কাঁচামরিচ আমদানির অনুমতি প্রদান করেন। এর পরই গতকাল বিকেলে থেকে বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হয়েছে। আমদানি অব্যাহত থাকলে কাঁচামরিচের ঝাঁজ কমবে বলে সাধারণ মানুষ আশা করছেন। বেনাপোল স্থলবন্দরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স উষা ট্রেডিং এর স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, “দেশে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভারত থেকে আমদানি কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২৫ জুন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে (খামারবাড়ী) কাঁচা মরিচ আমদানির জন্য আইপি প্রদান করেন।
বেনাপোল স্থলবন্দর উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কর্মকর্তা হেমন্ত কুমার সরকার বলেন, দেশের বাজারে ঈদের আগে থেকে হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেয়ায় আমদানি শুরু হয়েছে।
বেনাপোল কাস্টমস এর ডেপুটি কমিশনার তানভীর আহমেদ বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ০.৫০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করে খালাশ প্রদান করছেন। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজির মূল্য ৩২.২০ টাকা পড়ে। মোট শুল্ক হার ৫৮.৬০%। কাঁচা মরিচ বন্দর থেকে দ্রুত খালাশ দেয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ভারত থেকে ৬ ট্রাক কাঁচা মরিচ এসেছে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে। গতকাল রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বন্দর দিয়ে কাঁচা মরিচ বোঝাই ট্রাকগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ট্রাকগুলোতে ৭২ টনের মতো কাঁচা মরিচ রয়েছে বলে জানা গেছে। ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ৬ ট্রাক এসেছে। ভারতীয় পারে আরো বেশকিছু কাঁচা মরিচ বোঝাই ট্রাক অবস্থান করছে। সন্ধ্যার আগে সেগুলো বন্দরে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে আমদানিকারকরা জানান, ঈদের ছুটি শেষে আজ থেকে আমদানি শুরু হবে। আর আমদানি শুরু হলে কাঁচা মরিচের দাম আরও কমে আসবে। দুই একদিনের মধ্য দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
হিলি স্থলবন্দর উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের উপ-সহকারী মো. ইউসুফ আলী জানান, হিলি স্থলবন্দরের ৬ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই পর্যন্ত ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। কাঁচা মরিচ দেশে আসার পরেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। গত মঙ্গলবার রাজধানীসহ দেশের ৪১ জেলায় কাঁচ মরিচ ও চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ সময় ১১৮ টি প্রতিষ্ঠান কে ৬ লাখ ২১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গত বুধবার ৪০ টি বাজারে একই ভাবে অভিযান চালিয়ে ৩৫ ব্যবসায়ীকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫ শ জরিমান করেছে সংস্থাটি একদিনের ব্যবধানে ৩০০ -৪০০ টাকার আবার ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। অধিক মুনাফালোভী, স্বার্থান্বেষী, প্রভাবশালী মহলের টনক নড়ছে না। সরকারকে মাঝে মধ্যে বেকায়দায় ফেলার জন্য একটি কুচক্রিমহল, প্রভাবশালি কসিন্ডিকেটের মধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুন্যের ইচ্ছামত দাম বৃদ্ধি করছেন। সময় থাকতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবেই।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী