December 26, 2024, 11:04 am
রফিকুল ইসলাম, রাঙ্গাবালী পটুয়াখালী ঃ
সাগরকন্যা কুয়াকাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেসা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোকে নিয়ে ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে রাঙ্গাবালী উপজেলার সোনারচর, কলাগাছিয়ার চর, তুফানিয়ার চর, জাহাজমারার চর, চর হেয়ার ও দ্বীপ নিয়ে ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন। সর্বশেষ গত ২৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা বন্দরের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখিত চরসমূহকে নিয়ে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট স্পট তোলার বিষয়ে পুনরায় নির্দেশনা প্রদান করেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে শুধুমাত্র বন্ধের দিনগুলোতে পর্যটকরা আসতেন কুয়াকাটায়, কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্নতর, এখন প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটরা ভিড় করছেন কুয়াকাটায়। এদিকে এ বিপুল পরিমাণে পর্যটকদের আগমন কুয়াকাটায় ঘটলেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিশেষ করে তাদের পটুয়াখালী জেলার মধ্যেই নিকটবর্তী অন্য পর্যটন স্পটগুলোতে নিয়ে নৌ পথে যাওয়া-আসার উন্নতর কোনো বিশেষ ব্যবস্থা চালু নেই। যার ফলে একদিকে যেমন পর্যটকরা ঘুরতে এসে শুধুমাত্র কুয়াকাটার আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে যাচ্ছে তেমনি পুনরায় এখানে আসার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। কিন্তু এই কুয়াকাটা সাগর সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এক্সক্লুসিভ এলাকাগুলোতে শুধুমাত্র পরিকল্পিত নৌবিহারের মাধ্যমেই কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের করা যেতে পারে অধিকতর আকর্ষীত।
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে দ্বীপ হিসেবে জেগে ওঠা পটুয়াখালী জেলার এ সকল চরসমূহ মূল ভূখন্ড থেকে আনুমানিক ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এবং চরসমূহের অভ্যন্তরীণ দূরত্ব ৩-৫ কিলোমিটার। বিস্তৃত বনভূমির মাঝে শতাধিক ছোট-বড় খাল নিয়ে বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে উঠেছে দশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর ‘সোনারচর নামে দ্বীপটি। দুই পাশে সারি সারি গাছ, এর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ছোট বড় খালগুলো। সংরক্ষিত এ বনে রয়েছে কেওড়া, সুন্দরী, বাবলা, ছৈলা, করমচা গোলপাতা, সহ নানা প্রজাতির গাছ। বনে রয়েছে চিত্রা হরিন, মায়া হরিন, শুকর, বন বিড়ালসহ বিলুপ্ত প্রায় বিড়াল প্রজাতির এ সব প্রাণী ও পাখিদের অভয়ারণ্য। মনোরম এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের উত্তর এবং পশ্চিমে বুড়া গৌরাঙ্গ নদী এবং দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত যে সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বিরল মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংরক্ষিত এ বনকে বন্যপ্রাণীর জন্য অভায়রান্য হিসেবে ঘোষণা দেন।
বঙ্গোপসাগরের একবারে নিকটবর্তী রাঙ্গাবালী উপজেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজমারা চর। জাহাজমারার চরের সৈকত জুড়ে লাল কাঁকড়ার ছুটে চলার আলপনা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করে। রাঙ্গাবালীর উপজেলার কলাগাছিয়ার চরও চরতুফানিয়ার দীর্ঘ সাগর সৈকতেও রয়েছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করার বিরল মনোমুগ্ধকর সুযোগ।
পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার ও গলাচিপা উপজেলা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরের তীরে এসব চর ও দ্বীপের অবস্থান এবং এসব দ্বীপগুলোতে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। কিন্তু এসব চর ও দ্বীপে নৌ জেটি না থাকায় সেখানে নৌযান নোঙ্গর করতে অথবা নৌযান থেকে পর্যটকদের সেখানে ওঠা-নামা করতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে যা পর্যটন শিল্প বিকাশে একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। তাই রাঙ্গাবালীর এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে এসব চর ও দ্বীপে সুবিধাজনকের স্থানে নৌজেটি স্থাপনের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক তিনি বলেন, পটুয়াখালীর কুয়াকাটাকে ঘিরে এ অঞ্চলে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার অংশ হিসেবে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি।
এদিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে সাগর ভিত্তিক পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ‘ব্লুু ইকোনমিথ বাস্তবায়নেরও পথ সুগম করতে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। কুয়াকাটা সাগর সৈকত হতে সুসজ্জিত জাহাজ/লঞ্চের মাধ্যমে খাবার ও থাকার সুবিধা সংবলিত ‘বেক্রুজথ বা সমুদ্র বিহারের আদলে সুন্দরবনের কচিখালী /কটকা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত ভ্রমণের আয়োজন করা গেলে পর্যটকদের আমোদভ্রমণ ও রোমাঞ্চকর যাত্রার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার দফতর থেকে বিভাগীয় কমিশনার ২০ অক্টোবর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণ করছেন।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে বরিশাল ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী লঞ্চসমূহ যাত্রী সঙ্কটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা সাগর সৈকত থেকে সমুদ্র বিহার বা বেক্রুজ পরিচালনা করা গেলে লঞ্চগুলোকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে সচল রাখা সম্ভব হবে, তেমনি বরিশাল বিভাগের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া সমুদ্র বিহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা থেকে কচিখালী/কটকা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন গমন সম্ভব হলে তা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যা পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করা সহ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটায় দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী আরো কিছু রোমাঞ্চকর বিষয়াদি সংযোজন করা গেলে পর্যটকগণ অধিকতর আকৃষ্ট হবেন। এ ক্ষেত্রে কুয়াকাটা-কচিখালী/কটকা-সুন্দরবনের সাথে নৌ বিহার চালু করা গেলে তা এ অঞ্চলসহ দেশের পর্যটন শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে।