জিল্লুর রহমান,
মাগুরা প্রতিনিধি
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ও শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমাউনুর রশীদ মুহিত, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক এ এস এম রফিকুল আলা এবং বর্তমান প্রধান শিক্ষক শেখ আব্দুল মান্নান।
সাবেক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক এবং সাবেক সভাপতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু।বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সদ্য গঠিত এডহক কমিটির সভাপতি, বিশিষ্ট আয়কর উপদেষ্টা মির্জা ওয়ালিদ হোসেন শিপনের অনুমোদিত অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির তদন্তে এই অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের চিত্র প্রকাশ পায়।
বিদ্যালয়টি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধান শিক্ষক এ এস এম রফিকুল আলা ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়কালে এবং পূর্ববর্তী ছয় বছরেও কোনো অডিট না হওয়ায় তার ও সাবেক সভাপতির যোগসাজশে সাড়ে তিন কোটির বেশি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রফিকুল আলা অবসরে গেলে সহকারী প্রধান শিক্ষক মুনীর হোসেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হন। তবে তাকে কোনো পূর্বনোটিশ ছাড়াই মৌখিকভাবে অপসারণ করে সহকারী শিক্ষিকা সুবর্ণা জামানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়—যা সম্পূর্ণভাবে সরকারি বিধি-বহির্ভূত। এরপর মাত্র ৭ দিনের মধ্যে শেখ আব্দুল মান্নানকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র ১০ মাসের ব্যবধানে বর্তমান প্রধান শিক্ষকও ২৪ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে তা নিজে রেখে ভূয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ অডিট টিমের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আর্থিক অনিয়ম বিস্তৃত। ২০১৮ সালের পর থেকে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উৎস থেকে ৪ কোটি ১৩ লাখ ৬৬১ টাকা আয় হলেও ক্যাশবুকে দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৭০ লাখ ১০ হাজার ২১৩ টাকা। এর মধ্যে মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮১ টাকা ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। বাকি ৩ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ৮০ টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হুমাউনুর রশীদ মুহিত বিদ্যালয়ের সভাপতি পদ গ্রহণ করেন এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন। ২০১৮ সালে তিনি বিদ্যালয় ভবনের পাশে ১০৮টি দোকানঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেন। দোকান প্রতি ৩-৪ লাখ টাকা অগ্রিম গ্রহণ করা হলেও অধিকাংশের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্র বা রশিদ প্রদান করা হয়নি। এই খাত থেকে ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা আয় হলেও ক্যাশবুকে মাত্র ৯৪ লাখ ৫৯ হাজার ৩৫২ টাকা দেখানো হয়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রধান শিক্ষক রফিকুল আলা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে সভাপতির ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান ‘টপটেন ভাটা’র হিসাব নম্বরে ৫১ লাখ টাকা ট্রান্সফার করেন। তিনি অবসরের আগেই আরও ২৩ লাখ টাকা তিনটি চেকের মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ করেন।
এইসব অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে বর্তমান সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসেন শিপন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে অধিদপ্তরের নির্দেশে ২০২৫ সালের ২৪ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত বিদ্যালয়টি পরিদর্শন ও নিরীক্ষার জন্য একটি টিম কাজ করবে।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক শেখ আব্দুল মান্নান তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে বলেন, “ব্যাংকে টাকা জমা না দিয়ে হাতে রাখা এবং ব্যয় করাটা ভুল হয়েছে, তবে আমি সে টাকা সঠিক কাজে ব্যবহার করেছি। সব খরচের প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। সভাপতি না থাকায় শিক্ষকদের অনুরোধে তাদের বেতন দেওয়া হয়েছে এবং কিছু টাকা বিদ্যালয় উন্নয়নে খরচ করা হয়েছে।”
সাবেক সভাপতি ও সাবেক প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য জানতে একাধিকবার মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসেন শিপন বলেন, “বিগত সময়ে বিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে, নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে, কোনো কিছু নিয়ম মেনে হয়নি। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।