বিশেষ সংবাদদাতাঃ
বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রম করে দেশটি যেমন উন্নয়ন ও অগ্রগতির এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, তেমনি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক অবক্ষয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে, তা নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্ত,
নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রজ্ঞার ওপর।অর্থনৈতিক অগ্রগতি :আশার আলো,কিন্তু সতর্কতার প্রয়োজন গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে।দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে,মাথাপিছু আয় বেড়েছে,অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেশের সক্ষমতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। পদ্মা সেতু,মেট্রোরেল,এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে অগ্রযাত্রা-এসব অর্জন রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার প্রতীক। তৈরি পোশাক শিল্প,প্রবাসী আয় ও কৃষি খাত এখনো অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা রাখে। তবে মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ—এসব ঝুঁকি উপেক্ষা করলে অর্জন টেকসই হবে না।
রাজনীতি ও সুশাসন : ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মূল চাবিকাঠি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক চর্চা। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন কেবল পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। রাজনীতিতে সহনশীলতা,পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়,বরং জাতীয় ঐক্য ও সংলাপই পারে দেশকে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত করতে।
যুবসমাজ : সম্ভাবনার শক্তি,অবহেলার শিকার,
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার যুবসমাজ। প্রযুক্তি,উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতায় দক্ষ এই তরুণ প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নিতে পারে নতুন দিগন্তে। কিন্তু বেকারত্ব, মানসম্মত শিক্ষার অভাব ও কর্মসংস্থানের সংকট এই সম্ভাবনাকে ক্রমেই বাধাগ্রস্ত করছে। সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা তৈরির বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা না গেলে এই জনশক্তি বোঝায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তরুণদের সুযোগ দিতে পারলেই তারাই হবে আগামীর বাংলাদেশের প্রধান চালিকাশক্তি।
সামাজিক বাস্তবতা ও জলবায়ু সংকট : অদৃশ্য হুমকি নয়,সামাজিক ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয়,দুর্নীতি, মাদকাসক্তি ও বৈষম্য জাতির ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা এবং আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ ছাড়া এসব সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অস্তিত্বগত চ্যালেঞ্জ। নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—এসব মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল : সম্ভাবনার কূটনীতি,
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান, আঞ্চলিক ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বাংলাদেশকে একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় আরও কৌশলী ভূমিকা পালন জরুরি।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ আজ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সঠিক নেতৃত্ব, সুশাসন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও মর্যাদাশীল রাষ্ট্র। অন্যথায় এই সম্ভাবনার জানালা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। আজকের বাংলাদেশই নির্ধারণ করবে আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই এখনই সময় দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেওয়ার—কারণ ইতিহাস কখনোই সুযোগের জন্য দ্বিতীয়বার অপেক্ষা করে না।

Leave a Reply