রাজশাহী থেকে মো. হায়দার আলী : আশ্বিন মাসেই পদ্মা নদীতে পানির বড্ড আকাল। নদীর কাঁনায় কাঁনায় পূর্ণ হবার কথা খাকলেও সে অবস্থা নেই। তার একমাত্র কারণ মরন বাঁধ ফারাক্কার বিরুপ প্রভাব এবং ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার। ভারত খেয়াল খুশিমত ফারাক্কার খুলে আবার বন্ধ করে আমাদের দেশের সর্বানাশ করে।
নদীর দেশ বাংলাদেশে বর্তমানে নদীর এমন বেহালদশা। পদ্মা নদীসহ শ শ নদী মরে যাচ্ছে, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে । দেশে জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে । এখন শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা একটি নদীর নাম পদ্মা । এটা কি নদী ? বিশ্বাস করা যায় না । পদ্মার সেই খরস্রোত নেই কেন ? এমন সব প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে একালের শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রীসহ কোন আগন্তুককে । বিশাল-বিস্তৃত ধুধু বালুচর আর পানির ক্ষীণ বিল কিংবা লেকের মতো পদ্মার ঐতিহ্য অস্তিত্বকে এতটা বিপন্ন করেছে।
ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়েছে আবহমানকাল ধরে প্রবাহিত গঙ্গা-পদ্মা নদীর ভারতের অংশ ফারাক্কায় । ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ফরাক্কা ব্যরেজটি একতরফাভাবে নির্মাণ করে ভারত। কিন্তু ভারত কৌশলগতভাবে ব্যারেজটি তখনই চালু করেনি । তখন পাকিস্থানে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের ১৯৭০ সালের জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক শাসন জারি এবং সবশেষে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বধীনতা অর্জনের কাল। তারপরেও ভারত অপেক্ষা করে এবং অবশেষে ১৯৭৫ ইং সালের ২১ এপ্রিল ভারত ফারাক্কা চালু করার পর থেকে অব্যাহতভাবে মরণদশা শুরু হয়েছে ।
নদী আছে পানি নেই, বালু আছে কিন্তু কোথায় যেন কোন মাটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পদ্মার কোলে জেগে উঠা চরে সবুজ ফসল ফলানো সম্ভাব হচ্ছেনা । প্রতি বছর বালু জমতে জমতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে । পদ্মার ভয়াবহ রুপ দিনে দিনে হারিয়ে ফেলেছে । বিগত বছরগুলোতে এ নদীর ক্ষীণ স্রোতধারা থাকলেও এ বার তাও নেই । একটা বিলে পরিণত হয়েছে । এখন রেলবাজার ঘাটের সামনে মানুষ সাঁতার দিয়ে নদী পার হতে পারছেন। কয়েক বছর পর নৌকার পরিবর্তে গরুর গাড়ী কিংবা সাইকেলে নদী পার হওয়া যাবে বলে সচেতন মহলের ধারণা।
ফারাক্কা ব্যরেজের সব কয়টি গেট বন্ধ করে নদী শাসন করে মেরে ফেলা হয়েছে অসংখ্য নদ নদীকে জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে পরিবেশ জীবন জীবিকায় নেমে এসেছে প্রচন্ড ধ্বস। দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে । গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নীচে নেমে যাওযায় উত্তাঞ্চলের বেশীর ভাগ নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায় । দেখা দেয় তীব্র পানির সংকট । উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে এই ফারাক্কা ব্যারেজ; এসব এলাকার মানুষ যাকে মরণ ফাঁদ বলে জানে ।
এ ব্যারেজ চালু হওয়ার সময় বলা হয়েছিল এটি উভয় রাষ্টের কল্যাণের প্রতীক। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভরতের বিমাতাসুলভ আচারণের কারণে আজ এ ব্যারেজ দেশের মানুষের জন্য অকল্যাণ। একতরফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত তাদের বন্দর, কৃষি, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখলেও এদেশের কৃষি, নৌযোগাযোগ, পরিবেশ, জীবন-জীবিকাকে ঠেলে দিয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে । বিভিন্ন সময়ে পদ্মার পানি বন্টন নিয়ে অনেক আলোচনা মাপজোঁক আর পর্যবেক্ষণ হয়েছে । চুক্তি হয়েছে, চুক্তি নিয়ে সংসদে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়ছে। কিন্ত বাংলাদেশের ভাগ্যে কখনই চুক্তি মোতাবেক পানি জুটেনি । তবে পানি এসেছে সংসদে, টেলিভিশন, রেডিও, প্রিন্ট মিডিয়া, অন লাইন পত্রিকায়, টেলিফোনে। এর ফলে শুধু পদ্মা নয় অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানি ভারত একতরফা প্রত্যাহার করে চলেছে । ফলে এপারের নদ-নদীগুলো মরে যাচ্ছে ।
পদ্মা নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে শাখা নদী বড়াল, মরাবড়াল, নারোদ, মুছাখান, ইছামতি, চিকনাই, নাগর, ধলাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, হিসলা, কাজলা, চিত্রা, সাগোরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ মরে যাচ্ছে। কালিগঙ্গা, বেলাবত এসব নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে । বর্ষা মৌসুমে কিছু দিনের জন্য এসব নদীতে পানি থাকলেও প্রায় সারা বছর থাকে পানিশূন্য । তাছাড়া এসব নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে দু পার্শ্ব অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে । সরকারী দলের তথা কথিত যারা বালিখোর, টিআর গোর, টেন্ডার বাজ, সরকারী খাদ্য গুদামে গমখোর, খাস পুকুরখোর, তারা ড্রেজার, টলি, ট্রাক, লরি প্রকাশ্যে নামিয়ে নদী থেকে দেদারসে বালি মাটি নিয়ে গিয়ে ইটভাটা, ভরাটসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজ করায় পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীর পাড়, কোটি কোটি টাকার নির্মিত বাঁধ নষ্ট করে দিচ্ছে যা দেখার যেন কেউ নেই। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও তার দোসরগন বিএনপি জামায়াতের অসৎ নেতাদের হাত করে দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অবৈধ কান্ড। এ যেন মূদ্রার এপিট ওপিট। দেশের নদী এতটা বিপন্ন হয়েছে যেন এখন এসব নদীর নাম বইয়ের পাতায় কিংবা মানচিত্রে স্থান পেয়েছে ।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশর কোটি কোটি মানুষ বন্যা, খরা, জলচ্ছাসের কবলে পতিত হয়, সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়, দুঃখের সীমা থাকে না । অকালে ঝরে যায় লাখ লাখ মানুষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর প্রাণ । জলবায়ুর উপর দেখা দেয় বিরুপ প্রভাব। এর অন্যতম প্রধান কারণ মরণ বাঁধ ফারাক্কা । মৃত. মৌলানা আবদুল হামিদ খাঁন ভাসানী ফারক্কা ব্যারেজের বিরুদ্ধে ব্যারেজমূখি ফারাক্কা লং মার্চ করেছিলেন, ব্যরেজটির মারাত্বক পরিণতির কথা বিবেচনা করে ।
ভারত পানি না দিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার ভারতীয় অভিসন্ধির কারণে নদী স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শতাধিক ছোট নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বড় নদীগুলোর অস্তিত্বের সংকটও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রথমেই বলেছি ভাটির দেশ বাংলাদেশ, ভাটির দেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু উজানের দেশের না করার নীতি-বিধানের তোয়াক্কা না করেই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে।
গত ৫০ বছরে ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশের নদ-নদীতে যে বিরূপ প্রভাব রেখেছে তার বড় সাক্ষী বাংলাদেশে পদ্মা পাড়ের মানুষ।
ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত পানি সরিয়ে নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় মারাত্মক পানি সংকট তৈরি হচ্ছে। এক সময়ের খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মার বুকে বিশাল চর জেগেছে, নদীর গতিপথ সংকীর্ণ হয়ে গেছে, নদীটিই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
আবার বন্যার সময় সেই ফারাক্কারই সবগুলো গেট খুলে দেওয়া হচ্ছে। এরে ফলে প্রায় প্রতিবছরই গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা ও ভাঙনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পদ্মা নদী। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এ নদীটি উত্তরবঙ্গে রাজশাহী বিভাগ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
নদী গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের দীর্ঘতম এ নদীর গতিপথ থেকে শুরু করে এর শাখা নদনদীর প্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করেছে ফারাক্কা। ছোট বেলা থেকেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকায় পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করেন মোহাম্মদ রাব্বির হোসেন। পদ্মা নদীতে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নদীর পানি কমে যাওয়ায় মাছও অনেক কমে গেছে।
অতীতে তারা যেসব মাছ পেতেন, এখন আর সে ধরনের মাছ নদীতে ধরা পড়ে না। বর্ষা মৌসুমে কিছু মাছ ধরা পড়লেও বছরের অন্যান্য সময় বড় বড় মাছ এখন নদীতে মিলছে না। অনেকে মাছ ধরা পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলেও জানান রাব্বির হোসেন।
প্রায় ৩৫ বছর নদীতে থাকার অভিজ্ঞতার স্মৃতি থেকে ইয়াসিন আলী মাঝি বলেন, “পদ্মার অনেক শাখা নদীও গত ৫০ বছরে শুকিয়ে গেছে। আগে পদ্মা কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। শুষ্ক মৌসুমে এখন অনেক যায়গায় সরু খালের মতো পানি প্রবাহিত হচ্ছে।”
রেলওয়ে বাজার এলাকার মোঃ নাজমুল হোসেন বলেন,”যখন স্কুলে পড়ি তখন তো নদীতে সাঁতার দিয়েছি ব্যাপক খরস্রোত ছিল এখন মরা খালে পরিনত হয়েছে। এ নদীর শুকিয়ে যাওয়ার দুটি কারণ। একটা হলো ফারাক্কার বাঁধের জন্য এ নদীতে পানি আসছে কম। নদীটা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর আরেকটা কারণ হলো এখানে স্লুইচ গেট দিয়ে পানি এদিকে যেতে পারছে না,”
পুলিশের সাবেক এসআই, মহিশালবাড়ী বাজার কমিটির সদস্য মোঃ সাদেকুল ইসলাম বলেন, আমি প্রতিদিন সকালে নদীর ধারে হাঁটতে যায়। নদীর আগের অবস্থা নেই, হাক ডাক, গর্জন নেই যেন মরা খালে পরিনত হয়েছে। আগের মত রুপালী ইলিশ, বাঘাইড়, পাঙ্গাস, চেলি, রিঠা, বাশপাতা, কৈরি, ভোলা, চিংড়ি, বুয়াল, মলা, উড়ল, রুই, কাতলা, টেংরা, বাঁচা, ঘেড়া প্রভূতি মাছ পাওয়া যায় না। ফলে মৎস্যজীবিরা দিন দিন তাদের পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ বাপ দাদার পেশা উপায়হীন ভাবে ধরে রেখেছেন।
নদী গবেষকরা জানাচ্ছেন, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকেই বাংলাদেশে পদ্মা ও শাখানদীগুলোতে পানি সংকট শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ভারত একটি চুক্তি করেছিল ১৯৯৬ সালে যেটা ২০২৬ সালে শেষ হবে– সেই চুক্তির পর আমরা কিছু পানি পেয়েছি। কিন্তু তার আগে ২০ বছরে যে পানি আসে নাই তখন এই নদীগুলো মরে গেছে। গড়াইয়ের মতো নদীগুলো উঁচু হয়ে গেছে। যখন নদীখাত উঁচু হয়ে যায়, তখন পরে পানি দিয়ে খুব বেশি লাভ পাওয়া যায় না।
চলমান ৩০ সালা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যায্য পানিপ্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। আগের চুক্তিতে যতটুকু নিশ্চয়তা ছিল, এ চুক্তিতে তাও নেই। ফলে পানিবঞ্চনা আরো বেড়েছে। এ ব্যপারে বাস্তধর্মী পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরী বলে সচেতন মহল মনে করেন।
মোঃ হায়দার আলী
গোদাগাড়ী, রাজশাহী।
Leave a Reply