রাজশাহী থেকে মোঃ হায়দার আলীঃ আলবার্ট আইনস্টাইন এর মতে, “লাইব্রেরির অবস্থান জানা ঠিক পাঠশালার ঠিকানা জানা মতো”
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার শুধু বইয়ের ভাণ্ডার নয়—এটি জ্ঞান, কল্পনা এবং স্বপ্নের এক অনন্ত জগৎ। এখানে প্রতিটি বইয়ের পাতায় লুকিয়ে থাকে নতুন এক অভিজ্ঞতা, নতুন এক শিক্ষা। এসব কথাগুলির মূল্যয়ন করে
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল অজপাড়াগাঁ পনিহার গ্রামে এনায়েত উল্লাহ পন্ডিত গড়ে তোলেন লাইব্রেরির যার নাম ঐতিহাসিক বিখ্যাত পানিহার লাইব্রেরি। এখানে যে কেউ এসে পাঠাগারের গ্রন্থবলির বৈচিত্র্য ও বিপুল সংখ্যা দর্শন করে বিস্মিত হবেন। কতটা ঐকান্তিক আগ্রহ এবং সাধনা থাকলে এইরূপ একটি বিরাট সংখ্যার একত্র সমন্বয় করা যায়, সে শুধু কল্পনার বিষয়।” আমরা গর্বিত জাতি, গর্ব করার মতো এখনো অনেক কিছু আছে।
শেখ এনায়েত উল্লাহর জন্ম এই পানিহারেই। গ্রামটিতে যাতায়াতের জন্য আগে কোন পাঁকা সড়ক ছিল না। এনায়েত উল্লাহ প্রতিদিন হেঁটে যেতেন ১৩ কিলোমিটার দূরের স্কুলে। এভাবেই প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে পড়াশোনা করতে যান অবিভক্ত বাংলার নবাব বাহাদুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি যখন মাইনোর (এখনকার অষ্টম শ্রেণি) পাস করেন, তখন মারা যান বাবা। এনায়েতের স্কুলজীবনও এখানেই শেষ। কিন্তু বই পাগল এনায়েতের পড়ার ঝোঁক ছাড়ে না।
তিনি বই কিনতেন আর আলমারিতে সাজিয়ে রাখতেন। তখন গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত মানুষও তাঁর বাড়িতে গিয়ে বই পড়া শুরু করলেন। তা দেখেই আশেপাশের কিছু মানুষকে নিয়ে এনায়েত উল্লাহ প্রতিষ্ঠা করলেন পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি। তখনো পানিহারের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। গ্রাম থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ছিল বাসস্ট্যান্ড। আর ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল রেলস্টেশন। তবুও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই লাইব্রেরীতে আসতেন।
রাজশাহী থেকে বিখ্যাত ‘পানিহার লাইব্রেরী দেখতে গিয়েছিলাম গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী এক বন্ধুর সাথে। গোদাগাড়ী যাবার পথে বসন্তপুর মোড়, রাজশাহী মহানগরী থেকে ১৭ কিঃ মিঃ, সেখান থেকে ৭/৮ কিঃমিঃ গ্রোগ্রাম ইউনিয়ন হয়ে পানিহার গ্রাম। সেখানে জরাজীর্ণ ভগ্ন লাইব্রেরী দেখে কষ্টই হয়েছিল, এক সময়কার বিখ্যাত মনীষী ও গুণীজনের পদভারে আলোকিত সেই বিখ্যাত লাইব্রেরী দেখে।
গোদাগাড়ী উপজেলার বরেন্দ্রভূমির এক সময়কার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকার পল্লীর এক নিভৃত গ্রাম পানিহার। এই গ্রামের শিক্ষানুরাগী এনায়েত উল্লাহ পন্ডিত তাঁর বাড়ির সামনে ২ শতক জমির উপর মাটির ঘর ও টিনের চালা নির্মিত দুটি ঘরে এই ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরীটি ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন।
এই লাইব্রেরীতে বর্তমানে ত্রিশ হাজেরের মত নামী দামী দেশ বিদেশের বহু লেখকের বই রয়েছে। সাময়িকী পত্রিকা, উপন্যাস, কবিতা, বাংলা অনুবাদ,কাব্য ও কবিতা, বিশ্বকোষ, নাটক, জীবনী, রহস্য উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, ডিকেটটিভ, অর্থনীতি, উদ্ভিদ ও প্রাণী বিজ্ঞান বই ইত্যাদি।
গোদাগাড়ীর সাঁওতাল জনপদে জন্ম নেওয়া সাঁওতাল সংগ্রামী নেতা এনায়েত মাষ্টারের পরম বন্ধু শিক্ষানুরাগী সারগাম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে সংসদ সদস্য এল,এম,এ নির্বাচিত হলে এ লাইব্রেরীটি আরও সমৃদ্ধ হয়।
তৎকালীন মন্ত্রী প্রভাস লাহিড়ী, ধীরেন দত্ত, আইনুদ্দীন চৌধুরী,পল্লী কবি জসিম উদ্দীন,কবি বন্দে আলী মিয়া সহ অনেক দেশ বিদেশের কবি,সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ,গবেষক এই লাইব্রেরীতে এসেছেন এবং মুগ্ধ হয়েছেন। জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি তে এ লাইব্রেরির কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরেণ সুন্দর উপস্থাপনার অধিকারী হানিফ সংকেত। ৫০ হাজার টাকা অনুদানও হয়েছ।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের নাচোলের রানী খ্যাত তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইলা মিত্র এই গ্রামে লুকিয়ে থাকা অবস্হায় এই লাইব্রেরীতে যেতেন ও সময় কাটাতেন বলে কথিত রয়েছে।
১৯৭৫ সালে এনায়েত মাষ্টারের মৃত্যুর পর হতে ধীরে ধীরে এর অবকাঠামো দূর্বল হয়ে পড়ে, মাটির দেওয়াল খসে পড়ে, চালার টিনগুলো ফুটো ও মরিচাধরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে লাইব্রেরীটি এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তী সরকারী ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় ও চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় লাইব্রেরীটির ছাঁদওয়ালা পাঁকাঘর নির্মাণ করে দেন। ফলে বহুকালের পুরাতন গুরুত্বপূর্ণ বই সংরক্ষনের ব্যবস্থাকরনের ফলে লাইব্রেরীটি আবারো তার পুরাতন ঐতিহ্য ফিরে পায় ঐতিহ্য আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী জানান। আসুন আমরা এই লাইব্রেরীটিকে রক্ষা করি ও জ্ঞান অর্জনে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সহায়তা করি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদ পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই গ্রামীণ লাইব্রেরিটি একসময় ছিল শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এখানে এসে জ্ঞানের আলো ছড়াতেন। ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ—বই পড়া, আলোচনা, পাঠচক্র, প্রাণবন্ত উপস্থিতি।
কিন্তু আজ এই লাইব্রেরিটি তার প্রাণ হারিয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, এটি এখন প্রায় সারাবছর বন্ধই থাকে—শুধু কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এলে সাময়িকভাবে খোলা হয়, এরপর আবার তালা ঝোলে। ধুলো পড়ে, বই অযত্নে থাকে, কোন কার্যক্রম হয় না।
কাশিমালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ শওকত আলী জানান, একটি লাইব্রেরি শুধু ভবন নয়—এটি জ্ঞান, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও চিন্তার বিকাশের স্থান। পানিহার লাইব্রেরীতে দেশ বিদেশের অনেক বিখ্যাত লোকজন এসেছেন, বিবিসি, টেলিভিশন, স্থানীয়, জাতীয় পত্রিকা, ইত্যাদিতে প্রচার করা হয়েছে। আমি সংশ্লিষ্ট উদ্ধোর্তন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ করি যেন লাইব্রেরীটিকে আধুনিক ডেকরেশন করে জাঁকজমকপূর্ণভাবে সচল ও কার্যকর করতে। এককই মন্তব্য করেন দিগরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান।
লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যা এখন ৭ হাজার ৩১৫টি। এর বেশির ভাগই কলকাতা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন শেখ এনায়েত উল্লাহ। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় নিবন্ধিত গ্রন্থাগার ৩১টি। সর্বোচ্চ ৩২ হাজার ৫৪৪টি বই আছে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারে। এরপরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বই আছে গোদাগাড়ীর নিভৃত পল্লির সেই লাইব্রেরীতে।
প্রতিষ্ঠাতা শেখ এনায়েত উল্লাহর জীবন প্রদীপ থেমেছে অনেক আগেই। কিন্তু আজও নিভৃত পল্লির জ্ঞানের আলোর প্রদীপ হয়ে আছে তাঁর প্রতিষ্ঠা করা লাইব্রেরি। ১৯৭৫ সালের ৯ এপ্রিল পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি গিয়ে পরিদর্শন বইয়ে এ কথা লিখেছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়া।
১৯৮৯ সালেও জাইদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি লাইব্রেরিতে গিয়ে পরিদর্শন বইয়ে লিখেছেন, “দীর্ঘ পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে পানিহারে আসার সময় নিজের প্রতিই ভীষণ ক্ষুব্ধ হচ্ছিলাম। আমার বলতে এখন লজ্জা নেই, আসার সময় বারংবার মনে হচ্ছিল যেখানে আলো নেই, সভ্যতার বাইরে যারা বাস করে, সেখানে আবার লাইব্রেরি! অথচ এসে আমার চক্ষু চড়কগাছ! সত্যিই এ এক অগাধ জ্ঞানের সমুদ্রই বটে। যার কূল আমি হয়তোবা কোন দিনই পাব কি না, সন্দেহ।”
নতুন তিনটি ঘরে সারি সারি পুরনো দিনের আলমারিতে রাখা আছে সাহিত্য, কবিতা, বিজ্ঞান, শিশুসাহিত্য, অভিধান, ভ্রমণ, নাটক, ইংরেজি সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ, ইতিহাস, জীবনী, রম্যরচনা, উপন্যাস-রহস্য উপন্যাসের বই গুলো। বই ছাড়াও আছে শনিবারের চিঠি, মাসিক মোহাম্মদী, ভারতবর্ষ, সাপ্তাহিক নতুন দিন-এর মতো পুরনো পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী। দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো বিখ্যাত মনীষীদের ছবি। যত্ন করে রাখা হয়েছে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠাতা স্কুলশিক্ষক এনায়েত উল্লাহর ছবিও।
এখন একটি কমিটির মাধ্যমে লাইব্রেরীটি পরিচালিত হয়। গত শুক্রবার বিকালে লাইব্রেরিতেই পাওয়া গেল লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেনকে। তিনি জানালেন, আগে গ্রামের মানুষের বিনোদনের মাধ্যমই ছিল বই। এখন যুগ পাল্টেছে। সবাই মোবাইলে ব্যস্ত! তাও কিছু শিক্ষার্থী লাইব্রেরিতে আসেন। আর আসেন গবেষকেরা। পুরনো বইপত্র থেকে খুঁজে নেন নানা তথ্য। আগামী প্রজন্ম শুধু লাইব্রেরির নাম শুনবে, কিন্তু তার প্রাণবন্ত রূপ আর কখনও দেখতে পাবে না।
মোঃ হালদার আলী
রাজশাহী।
Leave a Reply