সাংবাদিকতায় সত্য প্রকাশে ঝুঁ-কি থাকবেই

শেখ সাইফুল ইসলাম কবির

সাংবাদিকতার মূল আত্মা হলো সত্য। একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র, কিংবা একটি জাতির বিবেক হিসেবে সাংবাদিকের দায়িত্ব থাকে সত্যকে খুঁজে বের করা, প্রকাশ করা এবং মানুষকে সচেতন করা। কিন্তু এ পথ কখনোই সহজ নয়। বরং সত্য প্রকাশের এই সাহসিক অভিযানে একজন সাংবাদিককে বহু ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়—কখনো রাজনৈতিক চাপে, কখনো কর্পোরেট প্রভাবে, কখনো আবার জীবননাশের হুমকিতে।

সত্য প্রকাশের পথে সাংবাদিকের মুখোমুখি ঝুঁকিগুলো কী?

১. রাজনৈতিক চাপ ও হুমকি

রাজনীতির আঙিনায় সত্য বলার মানে অনেক সময়ই ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। অনেক সাংবাদিককে শুধুমাত্র একটি রিপোর্টের জন্য হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, গ্রেপ্তার হতে হয়েছে, এমনকি প্রাণ হারাতেও হয়েছে। কোনো দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা স্বৈরাচারী আচরণের খবর প্রকাশ করলেই ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়।

২. আর্থিক ও কর্পোরেট প্রভাব

মিডিয়া অনেক জায়গায় কর্পোরেট স্বার্থে পরিচালিত হয়। স্পন্সরশিপ বা বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে অনেক সত্যিই চাপা পড়ে যায়। সাংবাদিক যদি কর্পোরেট দুর্নীতি বা অন্যায় কার্যকলাপ প্রকাশ করতে চায়, তখন সেই সাংবাদিকের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়, এমনকি চুপ থাকতে ‘অফার’ও দেওয়া হয়।

৩. সামাজিক ও মানসিক চাপ

সাংবাদিকদের অনেক সময় পরিবার, সমাজ বা নিজেদের নৈতিক সংকটের মধ্যেও পড়তে হয়। যদি তাদের প্রকাশিত কোনো সংবাদ কারও ক্ষতি করে, এমনকি সেটা সত্য হলেও, তখন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, কারণ সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানে প্রায়শই একা হয়ে যাওয়া।

৪. ডিজিটাল নজরদারি ও সাইবার হুমকি

বর্তমানে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি চলছে ডিজিটাল মাধ্যমেও। তাদের মেইল, ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটর করা হয়। আবার অনেক সাংবাদিক অনলাইনে ট্রল, হয়রানি বা হ্যাকিংয়ের শিকার হন। বিশেষ করে যারা মানবাধিকার, পরিবেশ, দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে কাজ করেন, তারা অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।

তবে কেন এখনও সাংবাদিকেরা সত্য বলেন?

কারণ, সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়—এটা দায়িত্ব, এটা নৈতিকতা। সাংবাদিকদের কলম বা ক্যামেরা অনেক সময়ই নিপীড়িত মানুষের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। সত্য প্রকাশ না করলে সমাজে অন্যায় ও দুর্নীতি বাড়তেই থাকবে। ইতিহাসের প্রতিটি বড় পরিবর্তনের পেছনে সাংবাদিকদের সাহসী ভূমিকাই এক বড় চালিকাশক্তি ছিল।

করণীয় কী?

আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা: সাংবাদিকদের জন্য স্বাধীন ও সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

সংবেদনশীলতা ও কৌশলের ব্যবহার: সত্য প্রকাশে দায়িত্বশীলতা ও তথ্য যাচাই অপরিহার্য।

প্রশিক্ষণ ও সমর্থন: নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নৈতিক সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক সহায়তা: আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর উচিত সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আরও সক্রিয় হওয়া।

উপসংহার

সাংবাদিকতায় সত্য প্রকাশের ঝুঁকি বরাবরই ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এই ঝুঁকি নিয়েই তো সমাজ জেগে ওঠে, পরিবর্তন ঘটে। যারা সত্যকে ভয় পায়, তারা চায় না সাংবাদিকতা বাঁচুক। আর যারা সত্যে বিশ্বাস করে, তারা জানে—সত্যই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।

সাংবাদিকতা যদি নিঃশ্বাস হয়, তাহলে সত্যই তার হৃদস্পন্দন।

শেখ সাইফুল ইসলাম কবির ।।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *