চারঘাটে সুশাসনের ছয় মাস, নেতৃত্বে একজন মানবিক ইউএনও

চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধিঃ

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা। বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের জন্য আলাদা পরিচিতি রয়েছে এ উপজেলার। তবে বিগত সরকারের সময়ে সরকারি সেবা দলীয়করণের কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সেবাবঞ্চিত জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে বর্তমানে উপজেলাটি নতুন চেহারায় রূপ নিয়েছে। এই পরিবর্তনের রূপকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাতুল ফেরদৌস।
গত ৩০ ডিসেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র ছয় মাসেই তিনি প্রমাণ করেছেন—সৎ উদ্যোগ, মানবিকতা ও একাগ্রতায় কতটা বদলে যেতে পারে প্রশাসনের ধারা। তিনি একাধারে ইউএনও, পৌর প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)। উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রশাসনিক দায়িত্ব একাই পালন করে চলেছেন।
ভূমি সেবায় স্বচ্ছতা ও আস্থা ফিরেছে
বিগত সরকারের সময় ভূমি অফিস ছিল সেবার নামে হয়রানির প্রতিচ্ছবি। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রভাব, দালালচক্র, ঘুস ও অসাধু কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য সাধারণ মানুষের মাথাব্যথার কারণ ছিল দীর্ঘদিন। জান্নাতুল ফেরদৌস দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ব্যবস্থায় কড়া নজরদারি শুরু করেন। অফিসে ঢোকার মুখেই এখন ‘দালালমুক্ত সেবা’—এমন বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। এখন প্রতিটি আবেদন যাচাই হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ঘুস কিংবা ভোগান্তি ছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নামজারি ও খতিয়ান প্রদান নিশ্চিত করেছেন তিনি।
ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা আফরোজা খাতুন বলেন, আগে ভূমি সংক্রান্ত কোনো কাজে আসলে পাত্তাই দিত না এখানকার স্টাফরা। কিন্তু এখন সবার আচার ব্যবহার পাল্টে গেছে। আমার বাবার দুইটা নামজারির আবেদন করেছিলাম। কেউ একটি টাকা চা খেতে পর্যন্ত চাইনি। ইউএনও স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। উনি সবকিছু মন দিয়ে শুনে দ্রুত সময়ে কাজগুলো করে দিয়েছেন।
পৌর প্রশাসনে পরিকল্পিত সেবা ও নাগরিক দায়িত্ব
চারঘাট পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস যা করেছেন তা শুধু কার্যকর নয় বরং ভবিষ্যত-ভাবনামূলকও। সরকার পরিবর্তনের পর দীর্ঘসময় পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়ে জটিলতা ছিল। কিন্তু এখন প্রতি মাসের শুরুতেই বেতন নিশ্চিত করে তাদের মধ্যে কাজের আগ্রহ ফিরিয়েছেন। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন নিজ উদ্যোগে।
দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির বিষয় ছিল জলাবদ্ধতা।
তাঁর উদ্যোগে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ড্রেন সংস্কার, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় এনেছেন নতুনত্ব। বিভিন্ন ওয়ার্ডে গঠিত নাগরিক কমিটির মতামতের ভিত্তিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পৌর সেবাগুলো ডিজিটাল ও তথ্যভিত্তিক করা হয়েছে—তাতে প্রতিটি নাগরিক জানেন কোথায়, কখন, কীভাবে সেবা পাবেন।
পৌরসভায় সেবা নিতে আসা মিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গত পাঁচ আগষ্টের পর জন্ম নিবন্ধন কিংবা নাগরিক সনদের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয়েছে। নতুন প্রশাসক আসার পর দিনের দিন এসব কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিগত সময়ে ভিজিএফ চাল পর্যন্ত দলীয়করণ করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম প্রকৃত উপকারভোগীরা চাল পেয়েছেন।
নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা
নারী হয়েও তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন নারীদের অনুপ্রেরণা। চারঘাটে নারী উদ্যোক্তা, নারী সহায়ক দল, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি—সবখানেই তার সক্রিয় সহযোগিতা ও নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালার (হস্তশিল্প, হাঁস-মুরগি পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা) আয়োজন করা হয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি উপজেলার নারীদের আইনি সহায়তা ও সহনশীলতা বিষয়ক সভা আয়োজন করে সবার মতামত শুনে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি সমান অধিকার নিশ্চিত
চারঘাটে তিনশটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা সরকারি সেবা থেকে পিছিয়ে ছিলেন। ইউএনও তাঁদের উন্নয়নেও নিয়েছেন বিশেষ উদ্যোগ। যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছেন।সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ভাষা টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন দিবসে উৎসাহমূলক সভা ও মেলা আয়োজন করেছেন। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর ভূমি অধিকার ও বসতঘরের জন্য সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করেছেন।
চারঘাট উপজেলা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সমিতির সভাপতি লুক সষ্ঠী পাহাড়িয়া বলেন, এই প্রথম কোনো প্রশাসক এত আন্তরিকতার সাথে আমাদের কথা শুনছে। সরকারি সেবাগুলো সঠিকভাবে আমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। গত সপ্তাহেও আমাদের পাঁচটি পরিবারের মাঝে গরু বিতরণ করা হয়েছে।
শিক্ষা খাতে দায়িত্বশীলতা, স্কুল পরিদর্শনে সরাসরি নজরদারি
একজন ইউএনও হয়েও শিক্ষা খাতে তাঁর আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। তিনি নিয়মিত উপজেলার স্কুল-কলেজগুলো পরিদর্শন করছেন, কথা বলছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে। বিদ্যালয়ের ঝরেপড়া রোধে বিশেষ সভা করছেন অভিভাবকদের নিয়ে। শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির বিষয়ে দিচ্ছেন সরাসরি নির্দেশনা। শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে স্কুলভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন। চলমান এইচএসসি পরীক্ষাতে নকলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করেছেন।
সরজমিনে ইউএনও জান্নাতুল ফেরদৌসের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে- গণশুনানি, বিভিন্ন বিরোধ মীমাংসা, পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণসহ প্রতিদিন নানাবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানেও নিরলসভাবে কাজ করছেন তিনি। এছাড়া মাদক প্রতিরোধে ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও পরিচালনা করছেন। পদ্মা নদী ভাঙন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ ও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েও উপজেলা জুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে চান্সপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তিতেও আর্থিক সহযোগিতা করেছেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চারঘাট উপজেলার সভাপতি মোঃ কামরুজ্জামান বলেন,
চারঘাটে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ইউএনও জান্নাতুল ফেরদৌস যেভাবে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন, তা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়ি

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *