হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন: ধর্মীয় বন্ধন থেকে আইনি স্বীকৃতির পথে

লিটন মাহমুদ, মুন্সীগঞ্জঃ
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিবাহ শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, একটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় আচার অনুসারে সম্পন্ন হওয়া বিবাহকে যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন এই সম্পর্কের আইনি স্বীকৃতি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং নারীর অধিকার রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। আজ এই সম্পর্কের শুধু ধর্মীয় নয়, আইনি ভিত্তিও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন একটি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।হিন্দু বিবাহকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে, তা এখন কেবল নথিভুক্তির বিষয় নয়—বরং নারী-পুরুষের সম্মান, অধিকার ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার অন্যতম নিয়ামক।
হিন্দুশাস্ত্র মতে বিবাহ: হিন্দুশাস্ত্র মতে, বিবাহ হলো সমগ্র জীবনে যে দশটি সংস্কার বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ সংস্কার। এটি মানবজীবনের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় দায়িত্ব, যেখানে নারী ও পুরুষ সংসার ধর্ম পালন ও চারটি পুরুষার্থ—ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ অর্জনের উদ্দেশ্যে একসঙ্গে পথচলা শুরু করে। বিবাহ নারী-পুরুষের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন স্থাপন করে এবং গৃহস্থ্য জীবনের সূচনা করে। এটি কেবল পারস্পরিক সম্পর্ক নয়, দুইটি পরিবারের মধ্যে আত্মিক বন্ধনও গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের হিন্দু বিবাহের প্রচলিত রীতি: বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ সাধারণত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করেই অনুষ্ঠিত হয়। পুরোহিতের উপস্থিতিতে মন্ত্র পাঠ, মালাবদল, অগ্নিসাক্ষী, সাত পাক ঘোরা, সিঁথিতে সিঁদুরদান ইত্যাদি ধাপে বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই আচারগুলো বিবাহের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং হিন্দু ধর্ম মতে পরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। তবে এসব বিবাহে ধর্মীয় রীতিতে সমাজে বৈধ বিবেচিত হলেও রাষ্ট্রের কাছে এর কোনো লিখিত স্বীকৃতি থাকত না।ফলে আইনি দলিল ছাড়া এই বিবাহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় না।
কেন প্রয়োজন হলো বিবাহ নিবন্ধন আইন: দেশের প্রচলিত আইনে মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ নিবন্ধনের বিধান থাকলেও হিন্দুদের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা ছিল না। নিবন্ধন ছাড়া বিবাহের আইনি স্বীকৃতি না থাকায় বহু হিন্দু নারী ও সন্তান নানা সময়ে ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার বা বৈধতার প্রশ্নে বঞ্চিত হন। স্বামী যদি সম্পর্ক অস্বীকার করেন বা হঠাৎ মারা যান, তবে নারীর হাতে কোনো লিখিত প্রমাণ না থাকায় আইনগত অধিকার হারিয়ে ফেলেন। এসব সমস্যার প্রতিকার ও নারীর অধিকার নিশ্চিত করতেই হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন প্রণয়নের দাবি ওঠে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ২০১২ সালে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়, যা ২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে পাশ হয়।
এই আইন কী এবং কাদের জন্য: আইন অনুযায়ী, হিন্দু রীতিতে সম্পন্ন বিবাহ নিবন্ধনের মাধ্যমে আইনি স্বীকৃতি পায়। এটি বাধ্যতামূলক না হলেও, যেকোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ এই আইনের আওতায় বিবাহ নিবন্ধন করতে পারেন। তবে শর্ত হলো—উভয় পক্ষকেই হিন্দু হতে হবে, এবং বিবাহ অবশ্যই ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হতে হবে।
আধুনিক যুগে বিবাহ নিবন্ধনের সুবিধা: সমাজে নারীর অধিকার, সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং দাম্পত্য জীবনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিবাহ নিবন্ধন এখন সময়ের দাবি। এটি নারীকে প্রতারণা ও অবহেলার হাত থেকে রক্ষা করে, আইনি সুরক্ষা দেয় এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে।
কী সুবিধা মেলে নিবন্ধনে: বিবাহের বৈধতা আইনত প্রতিষ্ঠা পায়। সন্তানের পরিচয় ও অধিকার নিশ্চিত হয়। স্বামী বা স্ত্রীর নামে সম্পত্তি দাবি করা সহজ হয়। পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রে স্বামী-স্ত্রীর নাম অন্তর্ভুক্তি সহজ হয়। আদালতে বিবাহ প্রমাণ সহজ হয়। ভবিষ্যৎ বিবাহবিচ্ছেদ, ভরণপোষণ বা সন্তান অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সুবিধা মেলে।
নিবন্ধন না করলে কী অসুবিধা: আদালতে বিবাহ প্রমাণ করতে ব্যর্থতা। নারী দাম্পত্য সম্পর্কের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন ফলে সম্পত্তি বা ভরণপোষণ দাবি জটিল হতে পারে। সন্তানদের জন্মনিবন্ধনে সমস্যার সৃষ্টি। সন্তানদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ, পেনশন দাবিতে জটিলতা দেখা দেয়। পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রে ‘ম্যারেড’ হিসেবে প্রমাণ অসম্ভব। বিদেশগমন বা সরকারি কাজে বিবাহিত পরিচয় প্রমাণ করা কঠিন হয়। ভবিষ্যতে আইনি লড়াইয়ে দুর্বলতা।
নিবন্ধনের পদ্ধতি: সিটি কর্পোরেশন, জেলা বা উপজেলার হিন্দু বিবাহ নিবন্ধকের কাছে আবেদন করতে হয়।বিয়ের মন্ডপে বা বিয়ের পর পাত্র-পাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি, বিবাহের তারিখ, স্থান ও সাক্ষীদের তথ্যসহ নির্ধারিত ফি জমা দিতে হয়।
শর্তাবলী: পাত্রের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর এবং পাত্রী ১৮ বছর। উভয় পক্ষ হিন্দু হতে হবে। বিবাহ ধর্মীয় রীতিতে সম্পন্ন হতে হবে। উভয় পক্ষের সম্মতি আবশ্যক। পূর্বে বিবাহিত হলে উপযুক্ত কাগজপত্র (মৃত্যু সনদ বা বিচ্ছেদ দলিল) থাকতে হবে।
বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়: বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আলাদা বিধান না থাকলেও পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে এ বিষয়ে মামলা করা যায়। তবে এখনো কোনো পৃথক “হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন” নেই, ফলে এ ক্ষেত্রে আদালতের ব্যাখ্যা ও পূর্বের রায় অনুসারে সিদ্ধান্ত হয়। বিচ্ছেদের পরে নারীরা স্বামীর নাম ব্যবহার বন্ধ করতে পারেন বা চালিয়ে যেতে পারেন, যা একান্তই তাঁদের পছন্দের ব্যাপার। বিচ্ছেদের পর স্বামী ভরণপোষণ দিতে বাধ্য, যদি স্ত্রী নিজে উপার্জনক্ষম না হন। সন্তানের দায়িত্ব—বিশেষ করে যদি সন্তান সাবালক না হয়—তা নির্ধারণ করে আদালত, যা সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করেই হয়। বিচ্ছেদের পর পুনরায় বিবাহ করতে আইনি বাধা না থাকলেও, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, বিশেষত নারীদের জন্য।
হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত না দিয়ে, বরং সম্পর্ককে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করে। এটি হিন্দু সমাজের জন্য এক ইতিবাচক অগ

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *