June 16, 2025, 12:36 pm
নিজস্ব প্রতিবরদক, রাজশাহী : রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও পৌরসভা এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ফার্মেসি। ওই সব ফার্মেসীর অনেক মালিক নিজের নামটি লিখতে কলম ভাঙ্গে অথচ ডাক্তার সেজে ঔষুধ ও ব্যবস্থা পত্র দিয়ে থাকেন। রোগ মুক্তি নয় ওষুধ বিক্রি যেন তাদের মুখ্য উদ্দ্যেশ্য।
অনেক সময় এমবিবিএস ডাক্তারগণ রোগীর অবস্থা ” নামীদামী কোম্পানীর ঔধুষ প্রেসক্রিপশনে লিখলেও ওই সব অর্ধশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত ওষুধ বিক্রেতারা বেশী লাভের আশায় ডাক্তারের লিখা ওষুধ পরিবর্তনও করে দিচ্ছেন অহরহ। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে আশাংকাজনকভাবে।
ওষুধ প্রশাসনের আইনে বলা হয়েছে, দোকানে মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনও ওষুধ বিক্রি বা মজুদ রাখা যাবে না। ড্রাগ সার্টিফিকেট টানানো থাকবে হবে। ওষুধ বিক্রয়ের সময়ে ক্রেতাদের প্রতিটি ওষুধের নাম মূল্যসহ ক্যাশ মেমো প্রদান করতে হবে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনও ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। দেশীয় ওষুধ ব্যতীত বিদেশি ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। এসব নিয়ম থাকলেও মানছেন না বেশির ভাগ ফার্মেসি।
ফার্মেসীর মালিকগণ ঔষধকে মনে করেন খাদ্যদ্রব্য, আলু, পটল কিংবা বেকারী পুন্য। বিক্রি করতে পারলেই হয়। অনেক মেয়াদ উর্ত্তীন ওষুধ, স্যাম্পল রেখে বিক্রি করা হচ্ছে দেদারসে। এমনকি কোম্পানীর নির্ধারিত মূল্যের উপর ওভার রাইটিং করে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কলম দিয়ে লিখে বিক্রি করা হচ্ছে ।
এদিকে ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান পরিচালনার খবর পৌছা মাত্রই গোদাগাড়ী পৌরসভার গোদাগাড়ী,, হাটপাড়া, সুলতানগজ্ঞ, মহিশালবাড়ী, সিএন্ডবি, রেলবাজার, মাওলানার গেট, উপজেলার রেলগেট, হাজীরমোড, হরিসংকরপুর, পিরিজপুর, বিদিরপুর, প্রেমতলী, কুমুরপুর, রাজাবাড়ী, কাঁঠালতোলা, কামারপাড়া, বাসুদেবপুর, বালিয়ঘাটা, কাঁকনহাট, ২৪নগর প্রভূতি এলাকার ২ শতাধিক ফর্মেসীর মলিক দোকান লাগিয়ে পালিয়ে যায় বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। যতক্ষন অভিযান চলে ততক্ষুন দোকান বন্ধ থাকে। এচিত্র অন্য উপজেলা ও পৌরসভা এলাকার।
কোম্পানী ওষুধের দাম বৃদ্ধি না করলেও ফার্মেসীর মালিকগন ইচ্ছা মাফিক দাম হাকাচ্ছেন, প্রশ্ন করলে ওষুধ বিক্রি নেই বলে তখন ক্রেতা সাধারন উপায়হীনভাবে কোম্পানীর নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশী কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় কিংবা শাস্তির বিধান কম হওয়ায় এ সব অবৈধ কারবার চলছে দেদারসে।
রাজশাহী জেলার সিভিল সর্জন ডা. এস.আই. এম. রাজিউল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ফার্মেসীর মালিক ঔষধের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ঔষধ প্রদানের বিষয়টি করতে পারেন না। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদেরকে ফার্মেসীর লাইসেন্স প্রদান করে থাকে বিষয়টি তারাই তদারকি করেন। এ ব্যপারে আমাদের কিছু করার নেই। তবে নিন্মমানের ঔষধ, মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ, বেশী মূল্যে ঔষধ বিক্রির বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। কেউ অভিযোগ করলে তাৎক্ষিন, উপজেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকারকে সাথে আমরা অভিযান পরিচালনা করা হয়। এটা আমাদের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আর এক প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, এটা জাতীয় ইস্যু, রোগি দেখার সময়, অফিস আওয়ারের মধ্যে বিভিন্ন কম্পানীর প্রতিনিধি /রিপ্রেজেন্টটিভ/ কর্মকর্তা কোনভাবে ভিজিট করতে পারবেন না। কোন উপঢৌকন, গিফট প্রদান, গ্রহন করতে পারবেন না। তবে সপ্তাহে ২ দিন রোগি দেখা ও অফিস আওয়ারের বাইরে কম্পানীর প্রতিনিধি/রিপ্রেজেন্টটিভ/ কর্মকর্তাগন ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করতে করে তাদের নতুন প্রডাক্টের ব্যপারে কথা বলতে পারেন। তিনি বলেন, কোন মেডিকেল এ্যাসিটেস্ট জেলা সদর, উপজেলা সদর, পৌরসভার মধ্যে কোনভাবে রোগি দেখতে পারবেন না। সাইনবোর্ডে, ব্যবস্থাপত্রে নামের আগে ডা. ব্যবহার করতে পারবেন না। শুধু মাত্র তারা গ্রাম্য এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে পারবেন।
মানুষকে ঔষধ সেবন, গ্রহনের ক্ষেত্র সচেতন হতে হবে। কোনা রেজিষ্টার ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র, পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন, ক্রয়বিক্রয় করতে পারবেন না।
রাজশাহীর ঔষধ অধিদপ্তরের তত্বাবধায়ক মোঃ শরিফুল ইসলামের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ড্রাগ লাইসেন্স ব্যতিত কেউ ফার্মেসী চালাতে পারবে। রাজশাহীতে প্রায় ৪ হাজার ৩৫ টি লাইসেন্সকৃত ফার্মেসী রয়েছে। এছাড়া গোদাগাড়ীতে ২৬৩ টি, তানোরে ১৭৮ টি লাইসেন্সকৃত ফার্মেসী রয়েছে। প্রতিবছর প্রতিবছর ৭ শ থেকে ৮শ ফার্মেসীর মালিক লাইসেন্স নাবায়ন করেন না। শ্রেণীভেদে ১৮ শ থেকে ২৫ শ টাকা নবায়ন ফি এর সাথে ১৫ ভাগ ভ্যাট যুক্ত হয়। যে সব ফার্মেসীর মালিক লাইসেন্স ছাড়া ঔষধ বিক্রি, মেয়াদ উত্তীর্ণ , নিন্মমানের ঔষধ বিক্রি করেন তাদের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব জনবল নিয়ে ঔষধ ও কসমেটিক আইন ২০২৩ অনুযায়ী, অভিযান পরিচালনা করা হয়। যারা ড্রাগ লাইসেন্স নিয়ে আর নবায়ন করেন না তারা আইনের চোখে বড় অপরাধী।
গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ হাসানুল জাহিদ বলেন, ফার্মেসীর মালিকগণ কোনভাবে রেজিস্টার ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া রোগিকে ঔষধ দিতে পারবেন না। নিজে কোনভাবে ব্যবস্থাপত্র, ঔষুধ দিতে পারবেন না। মেয়াদ উর্ত্তীন ওষুধ, স্যাম্পল রেখে বিক্রি করতে পারবেন না।
কোম্পানীর নির্ধারিত মূল্যের উপর ওভার রাইটিং করে বেশী দামে বিক্রি করতে পারবেন না। এটা আইনগতভাবে অপরাধ। এদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকারকে সাথে নিয়ে অভিযান চলছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন ফার্মেসীর মালিক জানান, মুদিখানা, চায়ের দোকান, পান সিগারেট এর দোকানে ঔষধ, সেলাইন বিক্রি হচ্ছে, গোদাগাড়ীতে অনেকের ড্রাগ লাইসেন্স নেই এবং লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন নেই। ফার্মাসিস্টের প্রশিক্ষণ সনদ নেই। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা একেবারেই উচিৎ নয়।
একজন নিয়মিত ঔষধ ক্রেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ওষুধ বিক্রেতা ও ক্রেতাকে বুঝতে হবে ওষুধ কোন খাদ্য দ্রব্য নয় এটি মূলত এক ধরনের বিষাক্ত দ্রব্য। নিয়মমাফিক ব্যবহার না করলে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক হুমর্কী হয়ে দাঁড়ায়। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার স্বীকার হচ্ছে অনেক রোগী। একজন মানুষ ১ পাতা ঘুমের ঔষধ নিতে আসলেও রেজিষ্টার ডাক্তারের ব্যবস্থা পত্র দিয়ে দেন এটা কিন্তু উচিত নয়। ফার্মেসী ব্যবসায়ীদের আরও সচেতন হতে হবে।
ডাক্তারী পরামার্শ ছাড়া এক রোগের ঔষুধ খেতে গিয়ে অন্য একটি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গোদাগাড়ীর বিভিন্ন ফার্মেসী গুলিতে সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঔষুধ বিক্রির কাজে জড়িতদের শতকরা ৯০ ভাগেরই ওষুধ সম্পর্কে ভাল ধারনা নেই। ফলে ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রোগীরা ধারনা পায় না। তারা ডাক্তারী প্রেসক্রিপশন চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভাব করে না। ক্রেতা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নাম উল্লেখ করে ঔষধ চাইলে ফার্মেসীর মালিকগণ ওষুধ বিক্রি করে থাকেন। আবার অনেক দিনের মেয়াদোর্ত্তীর্ন পুরানো প্রেসক্রিপশন নিয়ে অনেক রোগী ফার্মেসীতে আসলে প্রেসক্রিপশনের তারিখ ওষুধ সেবন করার সময়সীমা দেখার প্রয়োজনবোধও করেন না বিক্রেতাগন।
এদিকে বেশীর ভাগ ডাক্তারগণ কোম্পানীগুলোর বিভিন্ন রকমারী দামী উপঢোকনের (দামী উপহার সামগ্রী) কারণে রোগী দেখার চেয়ে বেশী সময় ব্যয় করে থাকেন কোম্পানী রিপ্রেজেন্টিভদের (প্রতিনিধিদের) সাথে। রোগী অসুখে কিংবা, পেট ব্যথায় ছটপট করলেও ডাক্তারদের মন এতোটুকু গলে না এখানে রোগী গৌন আর ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধি মূখ্য শুধু মাত্র দামী উপহার সামগ্রীর কারণে। গোদাগাড়ী মডেল হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, সততা ইসলামী হাসপাতালে দীর্ঘ লাইনে ঔষুধ কম্পানী গুলির প্রতিনিধিদের উপহার সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যান। এছাড়া ডাক্তারের রুম থেকে রোগির স্বজনেরা বের হওয়ার মাথে সাথে প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেন, ছবি তুলেন, কোন কম্পানীর ঔষুধ নিখেছেন, তারটা আছে কিনা, এ যেন রোগির লোকজন ও ঔষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের এক সংঘর্ষ।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য ডাক্তারী রোগী দেখা ফি এর উপর সরকার যে ভ্যাট বসিয়েছেন সেটির টাকাও রোগীদের নিকট থেকে গ্রহন করা হচ্ছে। এ অবৈধ কারবারটি জেলা শহর, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা শহরের নামীদামী ডাক্তারগণও করছেন নিজেদের খেয়াল খুশি মতো। শুধু কি তাই ডাক্তারদের সিরিয়্যাল দেওয়ার জন্য উৎকোচ দিতে হচ্ছে ১শ ৫০শ থেকে ২ শ টাকা। ভুক্তভোগী সচেতন মহলের দাবী জরুরী ভিক্তিতে এদের বিরুদ্ধে এদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহনের।
মোঃ হায়দার আলী,
নিজস্ব প্রতিবেদক,
রাজশাহী।