December 30, 2024, 6:04 pm
রাজশাহী থেকে মোঃ হায়দার আলীঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাশাপাশি জায়গায় মসজিদ ও মন্দির। দীর্ঘ শত বছর ধরে বাগবিতন্ডা ছাড়াই চলছে নামাজ ও পূজা। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অন্যন্য নিদর্শন স্থাপন করেছেন স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দির শ্রীমন্তপুরে (হাটপাড়া), শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টায় জুমআ’র নামাজের আজান শুরু হতেই থেমে যায় ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজ। এমন কী প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আজান ও নামাজের সময় পূজার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এভাবে চলে আসছে বছরের পর বছর। দুই ধর্মের লোকজনরাই নিজ-নিজ ধর্মীয় আচার ও নিয়ম পালন করছেন দীর্ঘ শত বছর ধরে। কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অনেক ধর্মীয় সম্পতি আছে যার দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তেমনি এক নিদর্শন রয়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার হাটপাড়া এলাকায়। এককই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দিরে শতবছর ধরে ধর্মীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতা পালন করে আসছেন দুই সম্পদায়ের মানুষ। সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাস্প কখনো আঁচর কাটতে পারেনি এখানে।
আযান শুনে মসজিদে ছুটে যান মুসল্লীরা আল্লাহর আনুগত্য লাভের আশায়, আদায় করেন নামাজ। মসজিদের পাশেই মন্দির শারদীয় দুর্গা উৎসবের জাঁকজমক আয়োজন, ঢাক-ঢোল কাশর আর উলুধ্বন্নীর শব্দ চয়নে প্রতিমা দর্শনে ভিড় করছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পৌর এলাকার পদ্মা নদীর পাশে হাটপাড়ায় একই আঙিনায় মসজিদ ও গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আর মসজিদ ও মন্দির কমিটির সদস্যরা এই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নেই কিভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। নামাজের সময় বন্ধ থাকে ঢাকের বাদ্য বাঁজনা।
মসজিদ কমিটির সদস্যরা বলেন, দীর্ঘ যুগ যুগ ধরে মসজিদ ও মন্দির পাশাপাশি আছে, আমরা জন্মের আগে থেকে দেখে আসছি, এখন পর্যন্ত এককই আঙিনায় আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের পূজা পালন করছে। আমরা মুসলমানরা লক্ষ্য রাখি তাদের যেনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
মসজিদ ও মন্দির সংলগ্ন জায়গা টিতে সনাতন ধর্মাবলম্বী যেমন তাদের পূজার কাজে ব্যবহার করে থাকেন, তেমনি মসজিদের মুসল্লীরা ওয়াজ মাহফিলে করেন।
মন্দির কমিটির সভাপতি শ্রী শান্ত কুুমার মজুমদার রাখু বাবু বলেন, এই মন্দির বহু বছর আগের পুরনো। এখানে পূজা পালন হয়, পাশেই আছে মসজিদ হিন্দু-মুসলমান আমরা একত্রিত হয়ে বসবাস করি। আমাদের অনেক ভালো লাগে। কোন প্রকার সমস্যা হয় না। মসুলমান ভাইয়েরা আমাদের যুগযুগ ধরে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছেন। এই মন্দিরটা একশ বছরের পুরনো। একই স্থানে মসজিদ ও গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দির। এ এলাকার হিন্দু-মুসলমানরা যার যার ধর্মীয় আচার পালন করে থাকেন। এ পর্যন্ত এখানে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তিনি আশা করেন- কখনও ঘটবেও না।
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আবুল হায়াত বলেন, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এককই স্থানে মসজিদ ও গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দির। মুসুল্লিরা নামাজের সময় নামাজ আদায় করছে আবার হিন্দু ধর্মের লোকজন পূজার সময় পূজা উদযাপন করছে। বিগত বছরের মতো এ বছরও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপিত হচ্ছে বলেও তিনি জানান। সাম্প্রতিক সম্প্রীতি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ আগামীদিনেও বজায় থাকবে বলে আশা করেন।
গোদাগাড়ী মডেল থানার ওসি মনিরুল ইসলাম, মসজিদ ও মন্দিরে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম সম্প্রীতি বজায় রেখে পালন করে আসছে। এই এলাকার মানুষের মধ্যে সামাজিক যে বন্ধন সেটি বিদ্যমান আছে। গোদাগাড়ীর হাটপাড়া কেন্দ্রীয় মন্দির ও জামে মসজিদ এই দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
প্রতিবছর ধুমধাম করে দুর্গাপূজা উদযাপন করে এলাকার সনাতনধর্মীর লোকজন। প্রায় একশো বছর থেকে একই আঙিনার কেন্দ্রীয় মন্দির ও জামে মসজিদ। মন্দির নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে কখনও ধর্মীয় কোনো দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়নি। একই সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমরা যার যার ধর্ম পালন করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মন্দিরে পূজা-অর্চনা চলছে, উলুধ্বনি ও ঢাকের বাজনাও আছে। পূজারি ও দর্শনার্থীরা প্রতীমা দেখতে এবং পূজায় অংশ নিতে ভির করছেন। নির্ধারিত সময়ে আজান শুরু হতেই থেমে যাচ্ছে, ঢাক-ঢোল-কাঁসর, মাইক ও উচ্চশব্দের বক্সের বাজনা। আজানের পর মুসল্লিরা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করছেন। নামাজ শেষ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের ঢাক-ঢোল-কাঁসর আর উচ্চশব্দের বাজনা।
গোদাগাড়ী আফজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম জানান, হিন্দুরা দীর্ঘ প্রায় ১ শ বছর ধরে এখানে পূজা করছেন। পাশে মসজিদ ও মন্দির থাকলেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না। ইসলাম ধর্মের মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। তারাও নামাজ ও আজানের সময় পূজা বন্ধ রাখেন। এটা কাউকে বলে দিতে হয় না। নামাজের আজানের সময় হলে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায় পূজার কর্ম। যুগ যুগ এই সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। সারা বছর এলাকার হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হিসেবে মিলেমিশে বসবাস করেন। ১০০ বছরের মধ্যে কোনো দিন দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনা তিনি দেখেন নি।
ইমাম ও আরবী বিভাগের অধ্যাপক মাও মো দুরুল হোদা জানান, তিনি জন্মের পর থেকে একই বাড়ির আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির দেখছেন। অভিজ্ঞ লোকদের নিকট হতে শুনেছি শত বছর থেকে এ মন্দিরে সনাতন ধর্মের লোকজন পূজা-অর্চণা করেন। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই একে অপরের পরিপুরক হিসেবে কাজ করেন। কোনো বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়- তারা সব সময় এ বিষয়টা লক্ষ্য রাখেন।
মোঃ হায়দার আলী
নিজস্ব প্রতিবেদক,
রাজশাহী।