গোদাগাড়ী (রাজশাহী) উপজেলা সংবাদদাতা : ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত রাজশাহী ১ এখানে সাধারণ বরাবরই হেবিওয়েট প্রার্থীগণ নির্বাচন করে থেকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনটি অন্যান্য আসনের চেয়ে বেশী আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে। বিএনপি জামায়াতবিহীন নির্বাচনে সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন চিন্তা ভাবনা দেখা না গেলেও ভোটারদের মাঝে নির্বাচনী উত্তাপ ছড়াচ্ছেন ৩ বারের নির্বাচিত এমপি, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি, স্বতন্ত্র প্রার্থী, রাজনীতি পরিবারের সন্তান গোলাম রাবাবানী, চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি।
রাজশাহীর সংসদীয় ৬টি আসনের মধ্যে এই আসনটিতে যেমন প্রার্থী সংখ্যা যেমন বেশি, তেমন রয়েছে আলোচনা-সমালোচনাও। এ আসনে ১২ জন প্রার্থীদের মধ্যে একজন প্রার্থী আওয়ামীলীগ নেতা, দেওপাড়া ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আকতাউজ্জামান আকতার গোলাম রাব্বানীকে সমর্থন করে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাড়িয়ে আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বড় চমক একজন চলচিত্র নায়িকা ভোটে অংশ নিয়েছেন। যার কারণে এ আসনের দিকে নজর সবার। অনেক আগে থেকেই এ আসনটির মাঠ গরম করে রেখেছেন প্রার্থীরা।
বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে তিনজনকে ভোটে অংশ নিতে আদালত পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়েছে। আবার কেউ অনেক দেরিতে প্রার্থীতা ফেরত পেয়েছেন। তারপরও সব প্রার্থী আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন জয়ের মালা গলায় পরায় আশায়। তবে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের শক্তিশালি স্বতন্ত্র চার প্রার্থীর মধ্যে একজন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এখনো মাঠে আছেন শক্তিশালি তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এলাকার সচেতন মহল বলছেন, এ আসনে নৌকার প্রার্থীকে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরেছে এসব স্বতন্ত্র তিন প্রার্থী। তবে তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর চেয়ে এখনো নৌকার পালে বাতাস বেশি বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। নৌকার প্রার্থী, অনেক বেশী শক্তিশালী, ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন এবং তিনি প্রচার প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছেন।
রাজশাহী-১ আসনে আওয়ামীলীগ থেকে বর্তমান এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী (নৌকা),
গোলাম রাব্বানী (কাঁচি), মাহিয়া মাহি (ট্রাক) বিএনএফের আল-সাআদ (টেলিভিশন), তৃণমূল বিএনপির জামাল খান দুদু (সোনালী আঁশ), এনপিপির নুরুন্নেসা (আম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের বশির আহমেদ (ছড়ি), জাতীয়পার্টির শামসুদ্দীন (লাঙ্গল), আয়েশা আক্তার ডালিয়া (বেলুন), আখতারুজ্জামান আক্তার (ঈগল) প্রতিক, বিএনএম’র শামসুজ্জোহা বাবু (নোঙর), নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন।
গত ১৫ বছর ধরে এ আসনে রাজত্ব করেছেন বর্তমান এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এই আসন থেকে তিনি একবার শিল্পপ্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন।
তবে গোলাম রাব্বানী ও মাহিয়া মাহি লোকজন প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে ব্যাপকহারে প্রচার করছেন ১৫ বছরে ওমর ফারুক চৌধুরির অধ্যক্ষসহ শিক্ষক পিটানো, নিয়োগ বানিজ্য, নেতা কর্মীদের সাথে খারাপ আচারন, সর্বশেষ তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামীলীগ নেতা নাজমুল হকের মোবাইল ভেঙ্গে সবার সামনে হাতে ধরিয়ে দেয়ার ব্যপারটি। এতে করেও কোন লাভ হবে না বলছেন ওমর ফারুক চৌধুরীর লোকজন।
তিনি দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাবেন না এমনটাও ধারণা করেছিলেন অনেকেই। যার কারণে এই আসনে নৌকা প্রত্যাশির সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুনঃরায় নৌকা উঠেছে ওমর ফারুক চৌধুরির হাতেই। তিনি নৌকা পেলেও আওয়ামী লীগেরই শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী, মাহিয়া মাহি, আয়েশা আক্তার ডালিয়ার মত শক্ত প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসনটি উদ্ধার করতে হবে ফারুক চৌধুরিকে। বলা যায়, ফারুক চৌধুরীর বিপরীতে তিনজন প্রার্থী অনঢ় অবস্থান নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিখাদ ভালবাসায় গোলাম রাব্বানীকে ঘিরে একটা শক্ত বলয় অনেক আগে থেকে গড়ে উঠেছে। রাব্বানী ব্যতিত এই বলয় কারো পক্ষে আনা সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক মহলেও আলোচনার ঝড় তুলেছে গোলাম বাব্বানী পক্ষ তারা শক্তভাবে অবস্থান করছেন। তিনি বিজয় নিশ্চিত জেনেও মুন্ডুমালা পৌর নির্বাচনে প্রার্থী হননি। তবে তার ঘনিষ্ঠজন প্রার্থী হয়ে বিশাল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন।
জানা গেছে,স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এক সময়ের অবিসংবাদিত নেতা, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, পাঁচন্দর ইউপির দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান, মুন্ডুমালা পৌরসভার দু’বারের সাবেক মেয়র খ্যাতি সম্পন্ন বর্ষিয়ান রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জননেতা গোলাম রাব্বানি রাজনীতিতে তাঁর হারানো গৌরব ফেরাতেই তিনি এমপি নির্বাচন করছেন। তিনি বিজয়ের ব্যপারে শতভাগ আশাবাদী। লোকজন ১৫ বছরের ক্ষমতার অবসান নিয়ে মাঠে নেমেছে রাব্বানীর পক্ষে।
জানা গেছে, গত ১৫ বছর ওমর ফারুক চৌধুরি এই আসনে রাজত্ব করলেও আওয়ামী লীগকে এক কাতারে আনতে পারেন নি। যার কারণে এই আসনে আওয়ামী লীগের মধ্যে সেভেনস্টার তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে ফারুক চৌধুরী মুষ্টিমেয় কিছু নেতাকর্মীদের মূল্যয়ন করার কারণে তানোর-গোদাগাড়ীতে বিগত দিনে তার বিরোধীতাকারীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। বর্তমানও বিরোধীতাকারীর সংখ্যা একেবারে কম নয় বলেও মনে করছেন নেতাকর্মীরা। এ কারণে এবার ফারুক চৌধুরীকে জয়ী হতে হলে অনেক বেগ পেতে হবে, এমনটা বলছেন নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা।
এ আসনে আওয়ামী লীগেরই শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন গোলাম রাব্বানী। এ আসনে গোলাম রাব্বানীর নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন থেকে এ আসনটি বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও পারেননি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও তিনি নৌকা প্রত্যাশি ছিলেন। কিন্তু পান নি। গোলাম রাব্বানী একজন হেবিওয়েট প্রার্থী বলেও মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। বর্তমান তার সাথে যোগ হয়েছে অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তরুজ্জামান। আক্তার নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানীকে সমর্থন দিয়েছেন। এতে গোলাম রাব্বানীর হাত আরো শক্তিশালি হয়েছে।
আওয়ামী লীগেরই অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে তানোর গোদাগাড়ীতে আসা-যাওয়া করেছেন। মাহি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার আবেদনকারী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নৌকা পাননি। নৌকা না পেলেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এবার মাহিকে নিয়েই মূলত এই আসনে আলোচনা-সমালোচনা বেশি হচ্ছে। মাহিকে সাধারণ মানুষ সিনেমার পর্দায় দেখেছেন। কিন্তু এবার সামনে থেকে প্রিয় নায়িকাকে দেখার আশায় লোকজন তার গণসংযোগে হাজির হচ্ছেন। মাহিকে যারা ভোট দেবেন তারা তো বটেই, যারা ভোট দিবেন না তারাও তাকে দেখার জন্য উপস্থিত হচ্ছেন গণসংযোগে।
সেই জায়গা থেকে মাহি অল্প সময়ের মধ্যে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। এখন মাঠ পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, ফারুক চৌধুরির বড় শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বি বলতে গোলাম রাব্বানী, মাহিয়া মাহি ও ডালিয়া । ফারুক চৌধুরীকে জয়ী হতে হলে এই ৩ জন প্রার্থীকে পেছনে ফেলে জয়ী হতে হবে। যদিও নেতা কর্মীরা বলছেন, ফারুক চৌধুরীপুনঃরায় এ আসনে নির্বাচিত হবেন। কারণ তিনি এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাও বেশি। তিনি নির্বাচনী মাঠে নেমে নিজের ভুলত্রুটি স্বীকার করে ভোটারদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। যার কারণে ফারুক চৌধুরির উপর যারা ক্ষিপ্ত ছিলেন তাদের কেউ কেউ ফিরে এসে তার সাথে কাজ করছেন। নতুন করে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মানেক, দেওপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আক্তারউজ্জামান। সাবেক কাউন্সিলর শাহাজামাল, মাহাবুব মেম্বার, অনেক ত্যাগি প্রভাবশালী নেতা প্রকাশ্যে ফারুক চৌধুরী বিরোধীতা করছেন। গোপনে অনেকে বিপক্ষে অবস্থা করছেন।
ওমর ফারুক চৌধুরী নির্বাচনী সভায় তার বক্তব্যে বলছেন, আমাদের আওয়ামীলীগের ৮০ হাজার নেতা, কর্মী ঐক্যজোট হয়ে নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করছে, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নৌকাকে বিজয়ী করবে ভোটারগন। তিনি অবশ্যই জনসম্মুখে মানুষের নিকট অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাচ্ছেন।
এ দিকে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি ওমর ফারুক চৌধুরীর ভোট ব্যাংক হিসেবে খ্যাত আদিবাসীদের মাঝে গভীরভাবে মিশে গেছে। তাদেরকে জড়িয়ে ধরা, তাদের বাচ্চাকে কোলে নেয়া, তাদের সাথে নাচা, গান গাওয়া, তাদের সাথে খাওয়াসহ সব কিছু করছেন। আদিবাসীগণ মাহিয়া মাহির পাঁ ধুয়ে দিচ্ছেন, ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন। মাহি সিনেমা স্টাইলে বক্তব্য দিচ্ছেন, আমার নির্বাচন ফারুক চৌধুরী সাহেবের বিরুদ্ধে, তিনি যে, ১৫ বছর জমিদারী স্টাইলে আপনাদের নির্যাতন করেছে, আপনাদের মেরেছে তার বিরুদ্ধে, উনি শিক্ষক পিটিয়েছেন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে পারে নি। আপনাদের সেঁচের পানি দিতে পারেন নি এর জন্য আপনাদের জীবন দিতে হয়েছে, নিয়োগ বানিজ্য করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে তার বিরুদ্ধে আমার নির্বাচন। আপনারা যদি আমাকে ভোটদিয়ে এমপি নির্বাচন করেন আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি সিনেমা করা ছেড়ে দিব, এখানে এসে আপনাদের সাথে থেকে যাব। এসব বক্তব্য উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিচ্ছে। তিনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানে হাজার হাজার মানুষ আগে থেকে ভীড় করছেন। ভোটের বিষয়ের চেয়ে তাকে এক নজর দেখার বিষয়টি বড় করে দেখছে অনেকেই।
মোঃ হায়দার আলী
গোদাগাড়ী, রাজশাহী।
Leave a Reply