ভূয়াপুরে কি মধু

আল আমিন শোভন,
স্টাফ রিপোটার, টাঙ্গাইল :-
টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে আয়তনের দিক দিয়ে বৃহত্তম থানা হিসেবে পরিচিত গোপালপুর থানার একটি অংশ ভাগ হয়ে ১৯৭৪ সনের ৭ আগস্ট ভূয়াপুর থানা নামে আত্মপ্রকাশ করার পর ১৯৮৩ সনে প্রথমে উন্নীত থানা ও পরে উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মাত্র ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ২১৬.৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলার সিংহভাগ এলাকাই হচ্ছে যমুনা নদী ঘেরা চরাঞ্চল। নিয়তির নির্মম পরিহাসের শিকার এই চরাঞ্চলের মানুষগুলো। প্রতি বন্যা মৌসুমেই বন্যার পানি কেড়ে নেয় খেতের ফসল, নদী গর্ভে বিলীন হয় ঘর—বাড়ি, আবাদি জমি ও নানা স্থাপনা। বন্যার জলে ভেসে যায় গবাদিপশু ও হাঁস—মুরগি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা বঞ্চিত দূরূহ যোগাযোগ ব্যবস্থাপূর্ণ এই দুর্গম অঞ্চলের অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচতে হয় নিয়তির সাথে যুদ্ধ করে। তবে দূর্দশাগ্রস্ত এই মানুষগুলোর অসহায়ত্ব ভাগ্যের চাকা বদলে দেয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসনের কিছু কিছু কর্মকর্তা—কর্মচারী ও ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা—কমীর্র। বন্যার জলে হাবুডুবু খাওয়া ভাঙনের কবলে নদী গর্ভে ঘর—বাড়ি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষগুলোর জন্য বরাদ্দ আসা ত্রাণ সামগ্রীর সিংহ ভাগই যেমন চলে যায় কর্তা ব্যক্তিদের পকেটে, ঠিক তেমনি শুকনো মৌসুমে চরাঞ্চলের রাস্তাগুলোও নির্মিত হয় শুধুই কাগজ কলমে—ভুয়া মাস্টাররোলে। আর তাই মজার ব্যাপার হলো— এই উপজেলা প্রশাসনে প্রথমে কেউ আসতেই চান না। কিন্তু একবার এলে আর যেতে চান না। ফলে সরকারি নিয়ম নীতি বর্হিভুতভাবে শুধু বছরের পর বছর নয়, যুগের পর যুগ অনেকেই চাকরী করছেন এই উপজেলা প্রশাসনে। সেই সাথে উপরি আয়ের গরম পয়সায় কেউ কেউ আবার রক্ষিতা পোষেণ বলে এলাকায় জনশ্রম্নতি শোনা যায়। অনেকেই আবার চাকরী করতে এসে এখানে জায়গা জমি ক্রয় করে পাকা বাড়ি থেকে শুরু করে বহুতল ভবন নির্মাণ করে স্থায়ী বসতি বনে যাওয়ায় সক্ষম হয়েছেন। আর তাই স্থানীয়দের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শোনা যায়— ভূয়াপুরে কি মধু ?
লৌহজং নদী তীরের ছোট্ট একটি মৌজার নাম ভূয়াপুর। ফলে বাজারের মাত্র একাংশই গড়ে উঠেছে মূল ভূয়াপুর মৌজার উপর। বাকি স্থাপনাগুলো সবই অন্য মৌজায়। বিশেষ করে উপজেলা পরিষদের সকল প্রশাসনিক ভবন ও আবাসিক ভবনগুলো এবং ভূয়াপুর বাস টার্মিনাল ও ট্রাক স্ট্যান্ড পুরোটাই ঘাটান্দী ও ফসলান্দি মৌজায়। ভূয়াপুর বাস টার্মিনাল ঘেষা টি—মোড় থেকে কাজল সিনেমা হলের উত্তরপাশ দিয়ে যে রাস্তাটি পূর্ব দিকে চলে গেছে তার দক্ষিণের অংশটি মূলত ঘাটান্দী আবাসিক এলাকা। আর এর উত্তরের অংশটি এক সময় পরিচিত ছিল ঘাটান্দী বালুচরা নামে। এই বালুচরার সিংহ ভাগেই কোন আবাদ হতো না। ছিল শনটাল। এরশাদ শাসনামলে রাতারাতি শহরে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে রয়েছে পল্লী বন্ধু এরশাদই বলেন, আর স্বৈরাচারী এরশাদই বলেন— এই রাষ্ট্রনায়কের অবদান। যার নীরব স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এরশাদ শাসনামলে নির্মিত উপজেলা প্রশাসন ভবন, কোর্ট ভবন, আবাসিক ভবন, থানা ভবন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন, টিএনটি ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন ইত্যাদি।
যা’ হোক ভূয়াপুর থানা উপজেলায় রূপান্তরিত হওয়ার বদৌলতে ঘাটান্দী বালুচরা রাতারাতি হয়ে ওঠে বহিরাগতদের আবাস ভূমি। অশিক্ষিত বাবা—মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া ছেলে—মেয়ে যেমন শিক্ষিত হলে বাবা—মায়ের দেয়া আদরের নামটি কদম আলী কিংবা ফালানী আর ভাল্লাগেনা। কদম আলী হয়ে যায় কুদরতে এলাহী আর ফালানী হয়ে যায় নন্দিনী। ঠিক তেমনি ঘাটান্দী বালুচরা পাল্টে হয়ে যায় ঘাটান্দী আদর্শপাড়া। কিন্তু এতে বাদ সাধে অনেকেই। যা’ রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় আফাজ উদ্দিন নামে এক যুবক। ফলে আদর্শপাড়া পাল্টিয়ে বালুচরা মাটিচাপা দিয়ে জায়গাটির নামকরণ করা হয় ঘাটান্দী নতুনপাড়া। তবে বারো রকম মানুষ এসে এখানে বসতি স্থাপন করায় রসিকজনেরা জায়গাটির নাম দিয়েছেন ঘাটান্দী বারোয়ারী পাড়া। আর নির্বাচন এলেই বেড়ে যায় এই ঘাটান্দী বারোয়ারী পাড়া কিংবা নতুনপাড়ার ভোটারদের কদর। তবে ভোট সংখ্যায় এগিয়ে থাকলেও পৌরসভা নির্বাচনে নতুনপাড়ার কোন প্রার্থী অদ্যাবদি বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। ঘাটান্দী নতুনপাড়া প্রসারিত হতে হতে ঘাটাইল থানার পশ্চিম সীমান্তবতীর্ গৌরিশ্বর মৌজার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম ভূয়াপুর, ফসলান্দি, বীরহাটি, বিরামদী, ছাব্বিশা, শিয়ালকোল, ভারই চরপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় বহিরাগতদের আবাস নির্মাণের ধূম পড়ার পাশাপাশি উপজেলা সদরের অদূরে মাস্টারপাড়া নামে চরাঞ্চলবাসীদের একটি বিরাট আবাসন গড়ে উঠেছে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, ভূয়াপুরে নেই কোন রাজনৈতিক সহিংসতা, বরং রয়েছে সকল দলের অনুসারীদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। সেই সাথে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় এগিয়ে থাকা ভূয়াপুর উপজেলা সদর বহিরাগতদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ায় কেউ একবার এখানে এলে আর যেতে চান না। আর তাই রসিকজনদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়— ভূয়াপুরে কি মধু ।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *