নদীমাতৃক বাংলার এক ভুলে যাওয়া ঐ-তিহ্যর নাম শাপলা শালুক

কুমিল্লা থেকে তরিকুল ইসলাম তরুন, বাংলাদেশের একসময় বাংলার বিল-হাওর ভরে থাকত এমন এক খাবারে যা ছিল ভাতের বিকল্প?
যা শুধু খাবার নয়, ছিল গ্রামীণ জীবনের আনন্দ, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি র অংশ?
হ্যাঁ, সেই ভুলে যাওয়া নামটি হলো— শালুক।

বাংলাদেশের নদীমাতৃক অঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্য একসময় ছিল গ্রামের মানুষের নিত্যসঙ্গী। নিচু অঞ্চলের দোআঁশ ও কাদামাটিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া শালুকের চারটি প্রধান জাত পাওয়া যেত। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, মাধবপুর, বৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নরসিংদীর হাওর ও খালচর অঞ্চলজুড়ে ছিল এই শালুকের প্রাচুর্য— যেন আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত।

ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মাস এলেই দেখা যেত বিলে উৎসবের আমেজ। কৃষক ও দামাল ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার ফাঁকে দলে দলে যেত শালুক তুলতে। হাসি-আড্ডায় মুখর হতো চারদিক। তখন শালুক, শাপলা, বেট, উঠা—এসব ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে নতুন খাবারের স্বাদ।

শালুকেরও ছিল নানা জাত— গাইয়্যা, সিন্ধু, রামউঠা সবচেয়ে জনপ্রিয়, আর কিছু প্রজাতি শালুকের মতো দেখতে হওয়ায় তাদের বলা হতো উডা, যেগুলো থেকে হতো শাপলা।

প্রতিটি শালুকের ওজন প্রায় ৪০–৭০ গ্রাম। এটি সেদ্ধ করে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ভাতের বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেত। পুষ্টিগুণে ভরপুর শালুক হজমে সাহায্য করত— গ্রামের মানুষ ভালোবেসে বলত, “শালুক খেলে পেটও খুশি, মনও খুশি।”

কিন্তু এখন?
বর্ষার পানি কমে গেছে, বিল শুকিয়ে গেছে, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে শালুকের দিনগুলোও।

তবুও সব শেষ হয়নি।
কুমিল্লার মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জে আজও কিছু মানুষ এই হারানো ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রায় বিশ বছর ধরে শালুকের ব্যবসা করছেন আবুল কাসেম, নারায়ণ, দীপ্ত সাহা, আবু মুছা ও সফিকসহ অনেকে।

তারা সিলেটের সুনামগঞ্জ ও মাধবপুর হাট থেকে বারো মাস শালুক সংগ্রহ করে কুমিল্লার বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন। পাইকারি দরে কেজি প্রতি ৫০–৮০ টাকা, খুচরায় ১৫০–২০০ টাকা। দীপ্ত সাহা বলেন, “প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০ কেজি শালুক বিক্রি হয়। এই ব্যবসাতেই আমাদের সংসার চলে, আর মনে হয় যেন একটা ঐতিহ্যকেও বাঁচিয়ে রাখছি।”

আজকের প্রজন্ম হয়তো শালুকের নামও শোনেনি,
কিন্তু এই মানুষগুলো প্রমাণ করছে—
যে ঐতিহ্যকে ভালোবাসা যায়, তাকে সময়ের স্রোতও মুছে ফেলতে পারে না।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *