রাজশাহী অঞ্চলে ফসলি জমি হ্রাস খাদ্য ঘা-টতির আ-শঙ্কা

আলিফ হোসেন,তানোরঃ
রাজশাহীর তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের
অর্থনীতি প্রায় সম্পুর্ণ কৃষি নির্ভর। তবে নির্বিচারে ফসলি জমি নষ্টের কারণে খাদ্য উদ্বৃত্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাবশালী ভুমিগ্রাসী চক্রের কৌশলের কাছে পরাস্থ হয়ে কৃষি জমির মালিকেরা অনেকটা বাধ্য হয়ে তাদের আবাদি
জমিতে পুকুর খনন করতে দিচ্ছে।এছাড়াও কল-কারখানা ও বাড়িঘর নির্মানে নস্ট হচ্ছে একেরর পর একর তিন ফসলী জমি। প্রভাবশালীরা প্রথমে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মধ্যে অল্প জমি বাছাই করে সেখানে কৌশলে পুকুর করা শুরু করে। এর পর ওই পুকুরের কারণে পাশের
জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তখন ওই সব জমির মালিকেরা ফসল উৎপাদনে লোকশানে পড়ে।এতে তারা তাদের আবাদি জমি
প্রভাবশালী ওই পুকুর খননকারীকে লীজ দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুকুর খননকারী বলেন, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকসহ সকলকে ম্যানেজ করতে বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ করলেই অনায়াসে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা যায়। তানোরের চাঁন্দুড়িয়া ইউনিয়নের (ইউপি) জুড়ানপুর, রাতৈল, হাড়দহ,বেড়লপাড়া,তানোর পৌর এলাকার মাসিন্দা,কামারগাঁ ইউপির হাতিশাইল, শ্রীখন্ডা, নেজামপুর প্রভৃতি এলাকায় বিএমডিএ’র গভীর নলকুপের স্কীমভুক্ত শত শত একর ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। অথচ এসব জমি এখানো কৃষি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তারা সরকারকে কৃষি জমির খাজনা পরিশোধ করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। কারণ পৌর এলাকায় পুকুরের বার্ষিক খাজনা ৫০ টাকা শতক, পৌরসভার বাইরে ৪০ টাকা শতক এবং কৃষি ও পতিত জমি ২ টাকা শতক। সেই হিসেবে ৩৩ শতক বা এক বিঘা আয়তনের একটি পুকুরের
খাজনা বছরে এক হাজার ৩২০ টাকা।কিন্ত্ত
কৃষি জমি দেখিয়ে এক বিঘা আয়তনের পুকুরে তারা খাজনা দিচ্ছে দু’টাকা শতক হিসেবে মাত্র ৬৪ টাকা। অর্থাৎ প্রতি শতকে ৩৮ টাকা করে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ফসলি জমিতে এসব পুকুর খনন করায় বিএমডিএর অনেক গভীর নলকুপ অকেজো হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্লাইস্টোসিন যুগের উচ্চভূমিকে বরেন্দ্রভূমি বলা হয়। পদ্মা, মহানন্দা, পুনর্ভবা, আত্রাই, বারনই ও করতোয়া নদীর অববাহিকায় এই উচ্চভূমির সৃষ্টি, যা বারিন্দ নামেও একসময় পরিচিত ছিল। এই উচ্চভূমি প্রাচীন গৌড় রাজ্যের অংশ ও এককালে রাজধানীও ছিল। রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিমাংশের ৯ হাজার ৩২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বরেন্দ্রভূমি। প্রাচীন এই ভূমির আরেকটি অংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, যা রাঢ় অঞ্চল নামে পরিচিত। এককালে মৌসুমী বৃষ্টিই ছিল এই ভূমির কৃষকের ফসল উৎপাদনের একমাত্র অবলম্বন। কালের পরিক্রমায় তপ্ত-উত্তপ্ত বরেন্দ্রভূমি এখন দেশের অন্যতম শস্যভাণ্ডার। সারা বছরই ধানসহ নানা ধরনের ফসল ফলছে এই ভূমিতে। তবে, ইদানিংকালে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে এখানকার ফসলি জমি। কৃষিবিদরা যদিও বলছেন, কৃষি প্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ছাড়াও কৃষকরা এখন লাভজনক কৃষিপণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। ধানের জমি উজাড় করে তৈরি হচ্ছে আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান। তিন ফসলি জমি কেটে খনন করা হচ্ছে পুকুর। এভাবে গত চার দশকে বরেন্দ্রভূমির প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ২৮০ হেক্টর ফসলি জমি কমে গেছে। ফলে বছর বছর কমছে ধানের উৎপাদন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অঞ্চলের তথ্যানুযায়ী, শুধু বরেন্দ্রভূমির রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলা-রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে গত এক দশকে ৯০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি কমেছে। বর্তমানে এই অঞ্চলের ধানের জমিতে গড়ে উঠছে বসতভিটা, ইটভাট, ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা, সবজিখেত, পুকুর ও আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান। যে কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। কৃষকরা বলছেন ফসলি জমি রক্ষায় আইন থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এদিকে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ভূমি জোনিং প্রকল্পের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্যানুযায়ী অপরিকল্পিত আবাসন, শিল্প-কারখানা, সড়ক নির্মাণসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে বরেন্দ্রভূমিতে প্রতিদিন কমছে ২২০ হেক্টর করে কৃষিজমি। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ মাত্র ১৪ শতাংশ। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জমির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। এর আগে ১৯৭২ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক একর ৩৫ শতাংশ করে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা অববাহিকার চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তিন দশক ধরে চলছে নদীভাঙন। এ ভাঙনে উদ্বাস্ত হয়ে প্রতিবছরই বহু মানুষ বরেন্দ্রভূমির ফসলি জমিতে গিয়ে বসতি গড়ছে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও পবার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল থেকে প্রতিবছরই শত শত উদ্বাস্তু মানুষের অভিবাসন ঘটছে বরেন্দ্রভূমিতে। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, রাজশাহীর তানোরের মুন্ডুমালা ও গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা, নাচোল, নেজামপুর, গোমস্তাপুর, নওগাঁর সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর এলাকায় গত কয়েক বছরে শত শত ভাঙন কবলিত মানুষরা গিয়ে বাড়িঘর বসতভিটা করেছে। এসব কারণেও বছর বছর কমছে ফসলি জমি। আশঙ্কাজনকভাবে ফসলি জমি উজাড় হওয়া প্রসঙ্গে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, কৃষিজমি ধ্বংস করে বসতি গড়ে ওঠা ছাড়াও পুকুর খনন ও ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। কৃষিজমি রক্ষায় আইন রয়েছে। তবে এই প্রবণতা বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষিজমির শ্রেণিও বদল করা হয়েছে, যা বেআইনি কাজ। বরেন্দ্র অঞ্চলে জমি উজাড়ের কারণে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে।#

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *