গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট ডিগ্রি কলেজর অধ্যক্ষ সুজা ৭ কোটি টাকা আ-ত্মসাৎ করেছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহীঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. সুজাউদ্দিন সুজার বিরুদ্ধে
ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৭ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ বাণিজ্য করে টাকা কামানের পাশাপাশি বিভিন্ন ফান্ডের টাকা কলেজ অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ছত্রছায়ায় থেকে তিনি এসব কাজ করেছেন বলে কলেজ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

অধ্যক্ষের এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন কলেজটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রতারিত ব্যক্তি ও এলাকার লোকজন। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে কাঁকনহাট পৌরসভা সদরে কয়েক দফা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। অধ্যক্ষের দুর্নীতি তদন্তের আবেদন জানিয়ে ৩১ জন শিক্ষক ও কর্মচারী গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সুজাউদ্দিনকে ২৩ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন কলেজটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আব্দুল হান্নান। নোটিশে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি নৈতিক স্খলন এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। অধ্যক্ষকে সাত দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

দুদকে দেওয়া অভিযোগ ও কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়, ২০১৬ সালের মার্চে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ-সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসাবে সুজাউদ্দিন অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান। এরপর ক্ষমতার দাপটে তিনি নিজের লোকজনদের নিয়ে কলেজ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন। গত এক দশকে ৩৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তিনি পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বেতন, ভর্তি ফি, সেশনচার্জসহ অন্যান্য ফান্ডের এক কোটি টাকা কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

এছাড়া ছাত্র উপবৃত্তির সামান্য কিছু টাকা কলেজ ফান্ডে জমা দিয়ে সাড়ে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। আইএফসি ব্যাংক রাজশাহী শাখায় কলেজের এফডিআরের সাড়ে আট লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন এমপিও করে দেওয়ার কথা বলে সাত লাখ টাকা নিয়েছেন। এমপিওভুক্ত হবে না জেনেও তিনজন অফিস সহায়ক নিয়োগ দিয়ে ৩৫ লাখ টাকা পকেটে ভরেছেন।

কলেজের আমবাগান লিজের দুই লাখ টাকা কলেজ ফান্ডে জমা দেননি। অভ্যন্তরীণ অডিটে প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকা গায়েবের প্রমাণ মিলেছে। শ্রেণিকক্ষের প্রজেক্টর কেনার নাম করে এক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কলেজ ফান্ড থেকে এক লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধ করেননি।

এছাড়া কাঁকনহাট সদর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার ফারুক হোসেন, সোহেল মাহমুদ, আনোয়ার হোসেন, আজাহার উদ্দিন, আব্দুস সালাম, হাফিজুর রহমান, মারুফ হোসেন ও শুভ নামের আটজনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ থেকে ১৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। পদ একটি থাকলেও একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে গোপনে অধ্যক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এদিকে গত ১০ বছর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কলেজের আয়-ব্যয়ের অভ্যন্তরীণ অডিট করতে দেননি অধ্যক্ষ সুজাউদ্দিন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অডিটের জন্য চাপ দেন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ ও শিক্ষক-অভিভাবকরা। এরপর গত জানুয়ারিতে গণিত বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মেসবাহুল হককে আহ্বায়ক করে অডিট কমিটি গঠন করা হয়। অডিটে মাত্র ছয় মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাবে প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকার গরমিল পাওয়া যায়।

প্রতারিত ফারুক হোসেন বলেন, লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরি দেওয়ার নামে অধ্যক্ষ আড়াই বছর আগে নয় লাখ টাকা নিয়েছেন। তিনি নিয়োগ না দিলেও টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। তার পেছনে পেছনে ঘোরার পর আমাকে ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ প্রাইম ব্যাংক রাজশাহী শাখার একটি চেক দেন। ব্যাংকে টাকা উঠাতে গিয়ে দেখি অ্যাকাউন্টটি ২০১৫ সালেই ক্লোজ হয়ে গেছে। এরপর আমি দুই মাস আগে অধ্যক্ষকে আসামি করে আদালতে মামলা করেছি।

অধ্যক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভভাবকরা বিক্ষোভ করছেন। এ কারণে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে কলেজে অনুপস্থিত তিনি। এর মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি মাত্র একদিন কলেজে যান। অবস্থান করেন মাত্র আধা ঘণ্টা।

কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আব্দুল হান্নান বলেন, ‘অধ্যক্ষ সুজাউদ্দিন একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি রাজশাহী শহরে পাঁচ কোটি টাকার একটি প্লট এবং চারতলা একটি বাড়ি কিনেছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কলেজ পরিচালনা পর্ষদও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’

কাঁকনহাট পৌরসভা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর জিয়াউল হক বলেন, সাবেক সংসদ-সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন সুজাউদ্দিন। আওয়ামী লীগের প্রভাব এবং ফারুকের দাপট খাটিয়ে অধ্যক্ষ কলেজ ফান্ডের টাকা তছরুপ করেছেন। অডিটেও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। অভিযোগ সম্পর্কে অধ্যক্ষ সুজাউদ্দিনকে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। তবে এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের বিক্ষোভে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্যের জন্য ফোনে কল দেওয়া হয়েছিল। সেদিন তিনি বলেছিলেন, অভিযোগ আসতেই পারে। তবে এটি প্রমাণ করতে হবে। অভিযোগ কেন করা হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি না।

মোঃ হায়দার আলী
নিজস্ব প্রতিবেদক,
রাজশাহী।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *