স্টাফ রিপোর্টারঃ
আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা ২০২৫ উপলক্ষে পূজামণ্ডপে কেউ বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, যানজট নিরসন, জঙ্গিবাদ, মাদক ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধসহ সাইবার অপরাধ দমনে সাংবাদিকদের সহযোগিতা অপরিহার্য। হিন্দু ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে কেউ গুজব বা উসকানি ছড়ালে কিংবা পূজামণ্ডপে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।তিনি আরও বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে দুর্গাপূজা উদযাপন নিশ্চিত করতে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।’
এদিকে ময়মনসিংহে দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ের কার্যক্রম চলছে। দুর্গা পূজাকে সামনে রেখে মন্দিরগুলোতে এখন প্রতিমা তৈরি আর মন্ডপ তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন আয়োজক সহ মৃৎশিল্পীরা, থাকছে নিরাপত্ত্বাবলয়। আসন্ন দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহে ব্যস্ত সময় পার করছে প্রতিমা তৈরীর কারিগররা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। উৎসবকে ঘিরে জেলার ৭৮১ টি মন্ডপে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় মাটির প্রতিমা হয়ে উঠছে অপরূপা। একই সঙ্গে দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণ করতে দিনরাত মন্দিরগুলোতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শক্ত মাটি নরম করে প্রতিমা তৈরির পর এখন রং তুলির আঁচড়ে মন্ডপে মন্ডপে চলছে কারিগড়দের ব্যস্ততা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ভক্তদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। উৎসব নির্ভিঘ্নে করতে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গেল বার শঙ্কা নিয়ে উৎসব করলেও এবার শঙ্কাহীন আনন্দ উদযাপনে সকল হিন্দু সংগঠন এক হয়ে পূজা করার আহবান আয়োজকদের।
ময়মনসিংহ পূজা উদযাপন পরিষদ সুত্রে জানা যায়, আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রমতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামী ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্যে দিয়ে দেবী পক্ষের সূচনা হবে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দেবীর বোধন ও মহাপঞ্চমী এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠীপূজার মধ্যে দিয়ে মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী এবং ৩০ সেপ্টেম্বর মহা অষ্টমী অনুষ্ঠিত হবে। ১ অক্টোবর মহানবমী এবং ২ অক্টোবর বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটবে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এ বছর দুর্গাদেবী গজে বা হাতির পিঠে চড়ে মর্ত্যে আগমন করবেন। আর দোলা বা পালকিতে চড়ে ফিরে যাবেন।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ বিভাগীয় মহানগরে ৯০টি সদর উপজেলায়-৪০টি, ধোবাউরায়-৩৫টি,ফুলপুরে-৫৭টি,গৌরীপুরে-৫৫টি,
গফরগাঁওযে-২০টি,ত্রিশালে-৬৮টি,ফুলবাড়িয়ায়-৬৪টি,মুক্তাগাছায়-১০৭ টা,ভালুকায়-৬৪টিসহ মোট ৭৮১ টি পূজামন্ডপে অনুষ্ঠিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।
জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে দুর্গাপূজা উদযাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সভা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়, পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একের পর এক সভা করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী অফিসাররাও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে খোঁজ খবর নিচ্ছেন।অন্যদিকে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ প্রশাসন পূজার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে জেলার পূজা উদযাপন কমিটি ও বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের সাথে বৈঠক করেছেন ।
ময়মনসিংহ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জানান- জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা সম্পন্নের লক্ষ্যে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এদিকে শারদীয় দুর্গোৎসবে শান্তি-শৃঙ্খলা ও উৎসবের আমেজ বজায় রাখতে সেনাবাহিনীও মাঠে রয়েছে। সেই সঙ্গে পূজা চলাকালীন গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সজাগ অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া তিনি পূর্র্বের ন্যায় শঙ্কাহীন উৎসব উদযাপনের আশা ব্যক্ত করেন। নিরাপত্তার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবকসহ ব্যবস্থা করেছেন সিসিটিভি ক্যামেরার। গত বছর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থতির জন্য ময়মনসিংহে জাঁকজমকে কিছুটা কমতি থাকলেও এবার তার পরিপূর্নতা পাবে বলে আশাবাদী পূজা উদযাপন পরিষদ।
পূজা উদযাপন পরিষদ, ময়মনসিংহের সাধারন সম্পাদক –জানান, শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে তাদের সব প্রস্তুতি শেষের দিকে। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সম্প্রতি আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশে সাথে আলোচনা সভা শেষ হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজামন্ডপে আমাদেরও সেচ্ছাসেবক কর্মী দায়িত্ব পালন করবে। তিনি আরো জানান, গত বছরের চেয়ে এ বছর ময়মনসিংহে পূজামন্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সরকারে পক্ষ থেকে প্রতিটা মন্ডপের জন্য চাল বরাদ্দ পেয়েছি। এ ছাড়া ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ও হিন্দু কল্যান ট্র্যাষ্ট এর পক্ষ থেকে ৮৮টি মন্ডপের জন্য আর্থিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রনালয়ের বরাদ্ধ প্রদান করেছে ।সব মিলিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এ উৎসবে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।তিনি বলেন আশা করছি কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই পূজা শেষ করতে পারবো। এবারের পূজা উপলক্ষ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যকরী দৃশ্যমান পদক্ষেপে সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা সন্তুষ্ট।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার প্রায় সব কটি পূজা মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। প্রতিমায় চলছে শেষ মুহূর্তের রং তুলির আঁচড়। প্রতিমা তৈরি ও সাজসজ্জার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা তৈরির কারিগররা। দম ফেলার ফুরসত নেই এখন কারিগরদের। ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডেকোরেটররা শুরু করেছে তোরণ নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজ।
কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যথাসময়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই দুর্গা দেবীর আরাধনার জন্য মন্ডপ গুলো প্রস্তত করা হবে। প্রতিমা তৈরির কারিগররা বলেন, প্রতিবছরই তারা অধীর আগ্রহে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজের অপেক্ষায় থাকেন। এর মধ্যেই দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির প্রায় কাজ শেষের দিকে। এখনও কিছু প্রতিমায় রংয়ের বাকি কেবল। কারিগররা আরো জানান, তারা একেকজনে একাধিক প্রতিমা তৈরি করছেন। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের প্রতিমা বিক্রি করে তারা লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। লাভ-লোকসান যাই হোক বংশগত পেশার প্রতি সম্মান জানিয়েই তারা আনন্দের সাথে প্রতিমা তৈরি করেন। প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে বিরতিহীনভাবে। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও পূজা উপলক্ষে একসাথে কয়েকটি মন্ডপের প্রতিমা তৈরীর কাজ পান এক একজন কারিগর। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই জেলাব্যাপী পূজা মন্ডপ তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিমা তৈরির সব কাজ শেষ করে কমিটির কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে বলে জানান কারিগররা।
অপরদিকে পূজার প্রস্তুতি দেখতে সরেজমিনে বিভিন্ন পূজা মন্ডপ ঘুরে দেখছেন জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম ও জেলা পুলিশ সুপার আখতার উল আলম।
পূজা প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণের এই উদ্যোগের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দ, পুরোহিত এবং ব্রহ্মচারীরা। তারা জানিয়েছেন, অতীতে পূজা চলাকালীন সময়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা মন্ডপ পরিদর্শন করলেও পূজার আগে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের এভাবে মাঠে নামা এবারই প্রথম।জেলা প্রশাসক পূজা মন্ডপে পরিদর্শন করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় মন্দির কর্তৃপক্ষ ও আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে সার্বিক প্রস্তুতির খোঁজ নিচ্ছেন।
কালীবাড়ি এলাকায় অবস্থিত এক মন্দির কমিটির সভাপতি বলেন, এই জেলা প্রশাসক খুবই আন্তরিক ও ভালো মানুষ। আমরা খুবই উৎসাহিত যে উনি নিজে আমাদের মন্দিরে এসেছেন। আমার জানা মতে, এর আগে কোনো জেলা প্রশাসক পূজার প্রস্তুতি দেখতে আসেননি, শুধু পূজার সময় এসেছেন।
দুর্গাবাড়ী রোড এলাকায় অবস্থিত এক মন্দিরে কর্মরত এক কারিগর বলেন, আমি কখনও দেখিনি একজন জেলা প্রশাসক প্রস্তুতি দেখতে সরাসরি এসেছেন। তিনি খুবই সিরিয়াস ছিলেন, বিশেষ করে নিরাপত্তা নিয়ে। পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক পূজা মন্ডপে নারী-পুরুষ পূজার্থীদের আসন বিন্যাস, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, প্রতিমা নির্মাণের অগ্রগতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করেন। তিনও জানান-পূজার সময় অনেকেই আসেন, কিন্তু প্রস্তুতি দেখতে জেলা প্রশাসকের আগমন এই প্রথম।
পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম জানিয়েছেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে নেয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। উৎসবকে নির্ভিঘ্ন করতে অনেক দুর্গম এলাকায় কিছু ঝুঁকিপুর্ন মন্ডপের তালিকা আমরা পেয়েছি। সেগুলোতে স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা করবো। এছাড়াও মোবাইল প্রেট্রোলিংসহ তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি মন্ডপে থাকবে পুলিশের নিয়মিত টহল। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি ।তা ছাড়া পূজাকে ঘিরে জেলায় গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম জানান, ময়মনসিংহে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গা উৎসব উদযাপনের লক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য ও সনাতন ধর্র্মের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে পূজা উদযাপন উপলক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে প্রস্ততিমূলক সভা সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশ বিভাগও নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে। পূজায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রতিটা মন্দিরেই পুলিশের পাশাপাশি আনসার ও গ্রাম পুলিশ কাজ করবে। সকলের প্রানবন্ত অংশগ্রহণে গত বছরের ন্যায় এবারও উৎসবমুখর এবং শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।
Leave a Reply