২৪৪ দিনের মধ্যে মাত্র ৪৯ দিন উপস্থিত থেকেও বহা-ল তবি-য়তে

বাবুল হোসেন,
পঞ্চগড় প্রতিনিধি :

শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও চিন্তা নেই, শিক্ষক দায়িত্বহীন, প্রধান শিক্ষক উদাসীন, শিক্ষা অফিসও নির্লিপ্ত, মাঠপর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে

শিক্ষা শুধু বই পড়ানো নয়, এটি একটি অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধের বিষয়। কিন্তু পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের ১৪০নং বাগানবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিশাত তাবাসসুম মৌয়ের আচরণে দায়িত্বশীলতার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই।

তিনি যোগদানের পর থেকেই প্রায় নিয়মিত অনুপস্থিত। চলতি বছরে ২৪৪ দিনের মধ্যে সরকারি ছুটি বাদ দিয়ে  ১৬২ দিনের মধ্যে মাত্র ৪৯ দিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। বাকি সময়ে হয় মেডিকেল ছুটি, নয়তো অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত। অথচ তিনি এখনও শিক্ষক পদে বহাল আছেন!

একজন শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকেন, তার সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। ছোট ছোট শিশুরা বলছে—“ম্যাম তো আসেন না, শুনেছি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।” শিশুদের এই নিরাশা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ।

সহকারী শিক্ষক নিশাত তাবাসসুম মৌ বলেন,

“আমি বর্তমানে শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব অসুস্থ। কিছুদিন আগে আমার মা মারা গেছেন, তাই মানসিক অবস্থাও ভালো নেই। এ কারণে আমি এখন বাইরে অবস্থান করছি। একবার মেডিকেল ছুটির জন্য লিখিত আবেদন দিয়েছিলাম, তবে পরবর্তীতে আর কোনো লিখিত আবেদন জমা দেওয়া হয়নি।

বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে নানা কারণে আমাকে ছুটি নিতে হয়েছে। কখনো অসুস্থতার জন্য, কখনো পরীক্ষার জন্য—বিভিন্ন কারণে আমি ছুটি নিয়েছি। তবে আমি সত্যিই অসুস্থ। কবে নাগাদ আবার বিদ্যালয়ে ফিরতে পারবো, সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। দেখি কবে থেকে নিয়মিত হতে পারি।”

প্রধান শিক্ষক আয়েশা সিদ্দিকা স্বীকার করেছেন যে, সহকারী শিক্ষকের অনুপস্থিতির বিষয়ে তিনি লিখিতভাবে জানাননি। কারণ—তিনি অসুস্থ ছিলেন। প্রশ্ন হলো—একজন প্রধান শিক্ষকের অসুস্থতা কি পুরো বিদ্যালয়ের দায়মুক্তির কারণ হতে পারে? প্রধান শিক্ষক যদি সময়মতো লিখিত পদক্ষেপ নিতেন, তবে হয়তো আজ বিষয়টি এভাবে প্রকট হতো না।

উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা জ্যোতিন্ময় রায় স্বীকার করেছেন—বিদ্যালয় ভিজিটের দিনও শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। তবু কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু “প্রধান শিক্ষকের লিখিত প্রয়োজন” বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রশাসনিক স্তরেও গাফিলতির কোনো অভাব নেই।

এই ঘটনাটি একটি বিদ্যালয়ের নয়, পুরো প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার প্রতিচ্ছবি। একজন শিক্ষক মাসের পর মাস শ্রেণিকক্ষে না এলেও কোনো জবাবদিহি নেই। প্রধান শিক্ষক দায়িত্বশীল নন, শিক্ষা অফিস নীরব দর্শক। তাহলে এই অবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বিদ্যালয় হলো শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার কারখানা। কিন্তু যদি সেই কারখানায় শিক্ষকই নিয়মিত না আসেন, তবে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ভেঙে পড়বে। নিশাত তাবাসসুম মৌয়ের অনুপস্থিতি শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার উদাহরণ নয়, বরং প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার নগ্ন চিত্র।

এখন সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। অন্যথায় “শিক্ষক আছেন কিন্তু শ্রেণিকক্ষে নেই” এই প্রবণতা আরও ছড়িয়ে পড়বে, আর তার খেসারত দিতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *