August 27, 2025, 4:58 pm

বিজ্ঞপ্তি :
বিশেষ সতর্কীকরন - "নতুন বাজার পত্রিকায়" প্রকাশিত সকল সংবাদের দ্বায়ভার সম্পুর্ন প্রতিনিধি ও লেখকের। আমরা আমাদের প্রতিনিধি ও লেখকের চিন্তা মতামতের প্রতি সম্পুর্ন শ্রদ্ধাশীল। অনেক সময় প্রকাশিত সংবাদের সাথে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে। তাই যেকোনো প্রকাশিত সংবাদের জন্য অত্র পত্রিকা দায়ী নহে। নতুন বাজার পত্রিকা- বাংলাদেশের সমস্ত জেলা, উপজেলা, ক্যাম্পাস ও প্রবাসে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে! বিস্তারিত: ০১৭১২৯০৪৫২৬/০১৯১১১৬১৩৯৩
শিরোনাম :
পানছড়িতে আ-ত্মসামাজিক উন্নয়নে সহা-য়তায় প্রদান করলো ৩ বিজিবি কুড়িগ্রামে মানব-সম্পদ উন্ন-য়নে জ-নস্বাস্থ্যের শৌ-চাগার নির্মাণ সুজানগরে আ-শ্রয়ণ প্রকল্পের জ-রাজীর্ণ ঘরে হ-তদরিদ্র মানুষদের ক-ষ্টের জীবন ঝিনাইদহ হিরা বেকারিকে ৪০ হাজার টাকা জ-রিমানা আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯ তম মৃ-ত্যুবার্ষিকী ঢাকায় আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ানের ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ-যাপিত বুড়িচংয়ে গ্রামের নাম পরি-বর্তন করে ভু-য়া শিক্ষক নি-য়োগের অ-ভিযোগ পাইকগাছায় ভাসমান বীজতলায় সফ-লতা পেয়েছে কৃষক ভালুকায় ৩ দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ অ-ভিযান ও বৃক্ষ মেলার উ-দ্বোধন জলাশয় অ-বৈধভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ায় রেল কর্মকর্তা রাশেদের বি-রুদ্ধে ত-দন্ত শুরু
আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯ তম মৃ-ত্যুবার্ষিকী

আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯ তম মৃ-ত্যুবার্ষিকী

লেখকঃ মো: হায়দার আলীঃ কি নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম, যেন ঠিক করতে পারছিলাম না। আজ বুধবার টিভি, স্থানীয় ও জাতীয়, অনলাইন পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হচ্ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯ তম মৃত্যু বাষির্কী বিষয়ে। তাই এবিষয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে লিখা শুরু করলাম। জানি না পাঠকগন কতটা উপকৃত হবেন।

আজ ১২ ভাদ্র, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলার বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত কাজী নজরুলের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ কুমিল্লা। নজরুলের রাজনীতি, প্রেম, বিয়ে, ব্যক্তিজীবন, সঙ্গীত ও সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে কুমিল্লা।

কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়েছেন শিক্ষা-সাহিত্যের পাদপীঠ কুমিল্লায় ১৯২১ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এরপর ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি কুমিল্লায় মোট পাঁচবার এসেছেন। প্রায় তিন বছরে পাঁচবার কুমিল্লায় এসে অবস্থান করেছেন ১১ মাসেরও বেশি সময়। কুমিল্লায় বিভিন্ন সময় অবস্থানকালে সৃষ্টিশীল নানা গান, কবিতা লিখেছেন তিনি। কবি নজরুলের রাজনৈতিক জীবনেও কুমিল্লার প্রভাব রয়েছে। তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখে শহরের রাজগঞ্জে গ্রেফতার হয়েছিলেন। কবি নজরুলের প্রাণের শহর কুমিল্লায় নজরুল প্রেমিরা কবিকে স্মরণ করে আপন মহিমায়।

কবি নজরুলকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক কর্মকা- ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝিতেই শুরু হয়। এর আগে ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি ও নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। কুমিল্লার সঙ্গে কবি নজরুলের সম্পর্কগুলো স্মৃতিফলক ও নামকরণে আজও চিরজাগরুক হয়ে আছে। কবি নজরুল কুমিল্লার মুরানগরসহ শহরের যেসব এলাকায় অবস্থান করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, গল্প করেছেন, সঙ্গীত-সাহিত্য চর্চা করেছেন সেসব স্থানে নামফলক, স্মৃতিফলক নির্মাণ করে চেতনায় কবি নজরুলকে ধারণ করে আছে কুমিল্লাবাসী।

১৯৮৩ সালে কুমিল্লার তৎকালিন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমানের উদ্যোগে নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় কুমিল্লায় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানে স্থাপন করা হয় স্মৃতিফলক। এরমধ্যে মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবি নজরুল মঞ্চ, মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়কের পাশে নজরুল তোরণ, আলী আকবর খানের দ্বিতল বাড়ি আঙ্গিনায় ‘আম তলা’ (যেখানে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন), কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা মসজিদের কাছে, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে (রানীর দিঘির পাড়ে), নজরুল এভিনিউ সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে, ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে, দারোগা বাড়ি, মুরাদপুর জানু মিয়া চৌধুরীর বাড়ি, দারোগা বাড়ি, চর্থায় শচীন দেববর্মনের বাড়ি, কান্দিরপাড় বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন এলাকায় স্মৃতিফলক রয়েছে।

অবিভক্ত বাংলার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।

প্রেমের, বিরহ-বেদনা ও সাম্যের কবি নজরুল বাংলা সাহিত্য-সংগীত তথা সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পুরুষ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে ভারতবাসীকে জাগিয়ে দিয়েছিল। তিনি পরিণত হন বিদ্রোহী কবিতে। সাম্ররাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার হয়ে কবি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান।
চির প্রেমের কবি নজরুল। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রুপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই তিনি অনায়াসে বলে গেছেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ পৃথিবীতে এমন কম মানুষই আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্কে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পরতে পারেন।
বাংলা কবিতায় নজরুলের আবির্ভাব একেবারেই উল্কার মত। হঠাৎ করে একদিন তিনি বাংলা সাহিত্যে আবির্ভুত হয়ে সমস্ত আকাশকে কীভাবে রাঙ্গিয়ে গেলেন অথবা উজ্জ্বল করে দিলেন তা নিয়ে এখনো গবেষণা হতে পারে।
কোন সঞ্জীবনি মন্ত্রে তিনি উচ্চকন্ঠে বলতে পারেন ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না /অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বস্তুনিষ্ঠ জীবনী লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের, অনেকেই লিখেছেন কিন্তু আমার সময় হয়ে উঠেনি। বর্ণাঢ্য কবিজীবনকে সব শ্রেণির পাঠকের জন্য সহজ করে, প্রামাণ্যতা অক্ষুন্ন রেখে উপস্থাপনের চেষ্টা মাত্র। তাঁর নজরুল জীবনকথা (প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ ২০১৬, ২য় মুদ্রণ, মার্চ ২০১৭) বইয়ে। ৩২টি অধ্যায়ে সাতাত্তর বছরের এক মহাজীবনকে তিনি ধাপে ধাপে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন।

নজরুলের জন্মগ্রাম চুরুলিয়ার নিকটবর্তী সাঁওতাল পরগনার বিদ্রোহী প্রতিবেশকে লেখক বিদ্রোহী নজরুলের প্রাথমিক চেতনাভূমি হিসেবে শনাক্ত করেন: ‘নজরুলের জন্মের দশ বছর আগেই এই অঞ্চলে ঘটে মুন্ডা বিদ্রোহ। এসব বিদ্রোহের গল্প ও গান চুরুলিয়া ও এর আশপাশের অঞ্চলের, বিশেষ করে একটু বেশি বয়সী মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর ছোটবেলায় এসব লড়াই-সংগ্রামের গল্প শুনেছেন বলে মনে হয়। তাঁর মনের গঠনে নিশ্চয়ই তা কমবেশি প্রভাব ফেলেছিল।’
শিয়ারশোল স্কুলের দুজন শিক্ষক-সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল ও হাফিজ নূরন্নবীর কথা আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেন লেখক; যাঁদের কাছ থেকে হিন্দুপুরাণ ও মুসলিম ঐতিহ্যের সমন্বয়ী সুর উপহার পেয়েছেন কবি।
এ বছরের ডিসেম্বরে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শতবর্ষ পূর্ণ হবে। ১০০ বছর আগে এই কবিতা লেখার সেই স্মরণীয় রজনী যেন ছবির মতো অক্ষরে এঁকেছেন মোরশেদ শফিউল হাসান:
‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির যে ঘরটিতে নজরুল ও মুজফফর আহমদ থাকতেন, সেখানে বসেই ১৯২১ সালের বড়দিনের ছুটির সময় এক রাতে নজরুল তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতাটি লেখেন। কবিতাটি তিনি প্রথমে লেখেন পেনসিল দিয়ে। সেকালে বলপেন এমনকি ফাউন্টেন পেনেরও চল ছিল না। দোয়াতে বারবার কলম ডুবিয়ে লিখতে হতো। মুজফফর আহমদের মতে, এভাবে লিখতে গিয়ে পাছে তাঁর ভাবনায় ছেদ পড়ে, তাই নজরুল পেনসিল দিয়েই পুরো কবিতাটি লিখেছিলেন।’

এ বছর নজরুলের কুমিল্লা আগমনেরও শতবর্ষ। তাঁর জীবন ও সৃষ্টিতে ‘কুমিল্লা’ এক বিশিষ্ট অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯২১ সালে কয়েক দফা কুমিল্লা আগমন ও অবস্থান, দুই ভুবনের দুই নারীÑনার্গিস ও প্রমীলার সঙ্গে সহৃদয় সংযোগের পাশাপাশি তৎকালীন কুমিল্লার বিপ্লবী আবহে লেখক তুলে ধরেছেন নজরুল ইসলামকে:
‘সময়টা তখন অসহযোগ আন্দোলনের। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সারা দেশে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সে আন্দোলনের ঢেউ ত্রিপুরার মহকুমা শহর কুমিল্লাতেও এসে লেগেছে। নজরুলকেও এ সময় রাজনৈতিক নানা সভা-মিছিলে অংশ নিতে দেখা গেল। মিছিলের সামনে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে নিজের লেখা গান গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করছেন তিনি। সেই গানের কথা ছিল:
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী
সন্তান দ্বারে উপবাসী…’
লেখক নজরুলের জীবনী লিখতে গিয়ে তাঁর সমসাময়িক কাল সম্পর্কেও সম্পূর্ণ সচেতন। তাই ধূমকেতু পত্রিকায় ১৯২২-এর ১৩ অক্টোবর ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়ে লেখা নজরুলের সম্পাদকীয় প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি উর্দু কবি ও রাজনীতিক হসরত মোহানির প্রসঙ্গ, যিনি এর আগে ১৯২১-এর ডিসেম্বরে একই দাবি উত্থাপন করেছিলেন: ‘যত দূর জানা যায়, বাঙলা দেশে নজরুলই প্রথম, এমনকি সমগ্র ভারতবর্ষেও মওলানা হসরত মোহানির পর দ্বিতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি প্রকাশ্যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান।’
হুগলিতে বসবাসকালে হুগলি, নৈহাটির শ্রমিকদের কবিতা পড়ে শোনানো, তাঁদের শ্রান্তি বিনোদনের জন্য বাংলা ও হিন্দি গান গাওয়া, চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিলে নামার তথ্য প্রমাণ করে নজরুল শুধু লেখাতেই নয়, বাস্তবেও ছিলেন মাটির কাছাকাছি কবি। ১৯২৭ সালে গণ-বাণী পত্রিকায় ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’ শিরোনামে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংগীতের নজরুল-কৃত বাংলা রূপান্তর প্রকাশ পায়: ‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত।’
নজরুলের প্রাণছোঁয়া অনুবাদ বিষয়ে লেখকের পর্যবেক্ষণ: ‘এই অনুবাদটি করার সময় নজরুল ইউজেন পত্তিয়েরের লেখা মূল ফরাসি গানটির কিংবা তার ইংরেজি বা অন্য কোনো অনুবাদের নোটেশন বা স্বরলিপি দেখার সুযোগ পাননি। তার পরও নজরুলের অনুবাদ সম্পর্কে মুজফফর আহমদ বলেছেন: “বাংলা ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট তো বটেই, আমার বিশ্বাস ভারতীয় ভাষাগুলিতে যতসব অনুবাদ হয়েছে সে-সবের সেরা”।’
নজরুল-জীবনের অনেক অজ্ঞাত বা স্বল্পজ্ঞাত তথ্যের সমাহার এই বই। যেমন ১৯২৯ সালে এক কৃষক সম্মেলনে কুষ্টিয়া সফরকালে চারণকবি মুকুন্দ দাসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও সখ্যের বিবরণ পাই: ‘নজরুলের কুষ্টিয়া অবস্থানকালীন কুমারখালীতে তাঁকে একটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়। চারণকবি মুকুন্দ দাস সে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনার উত্তরে দেওয়া বক্তৃতায় নজরুল মুকুন্দ দাসকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “যাঁরা গান বা বক্তৃতা দ্বারা দেশের জাগরণ আনতে চেষ্টা করেন তাঁরা সকলেই চারণ। আপনি, আমি, আমরা সবাই চারণ, তবে আপনি আমাদের স¤্রাট, অর্থাৎ চারণস¤্রাট”।’
বাংলা গানের বুলবুল নজরুলের সংগীতজীবন নিয়ে তিনি বিশদ ও মনোহর আলোচনা করেছেন। নজরুলের রাগরাগিণীর তত্ত্বীয় প্রসঙ্গের সমান্তরালে অনায়াসে আসে ১৯৩৪ সালে কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে ‘কলগীতি’ নামে নজরুলের গ্রামোফোন যন্ত্র ও রেকর্ড বিক্রির দোকান খোলার অনুষঙ্গ। দাবা খেলার আমুদে খতিয়ানের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের কথাও। রঙ্গমঞ্চের নজরুলও থাকেননি অনালোচিত। নজরুল জীবনকথায় পাই সর্বত্রগামী এমন নজরুলকে:
‘নজরুলের লেখা গীতিনাট্য মধুবালার অভিনয় দিয়েই ১৯৪০-এর দশকের গোড়ায় নাট্যভারতী থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করে। এতে গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন হরিমতী ও রাধারাণী দেবী। মধুবালা যে চল্লিশ রজনী চলেছিল, তা এই গানগুলোর আকর্ষণেই।’
এই বইয়ে কিছু প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করেছেন মোরশেদ শফিউল হাসান। ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শিরোনামে ১৯৪১-এর এপ্রিলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসবে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণকে অনেকেই তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ বা বক্তৃতা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে নজরুল জীবনকথায় লেখক জানাচ্ছেন, এর কয়েক মাস পর ১৯৪১-এর সেপ্টেম্বরে হাওড়ায় রবীন্দ্র-স্মরণ অনুষ্ঠানে এবং একই সালের ২৯ নভেম্বর হাজী মোহাম্মদ মুহসীনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভাতেও তিনি বক্তৃতা প্রদান করেন।
এরপর ৩৫ বছরের নিস্তব্ধতা। নজরুল বেঁচেছিলেন ১৯৭৬ পর্যন্ত কিন্তু ১৯৪২ থেকেই তাঁর অসুস্থতার শুরু। লেখক এই সময়কালে নজরুলের চিকিৎসা তৎপরতা এবং ১৯৪৭-এ বিভক্ত বাংলার দুই অংশে নজরুলচর্চার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন। একদিকে কায়েমি স্বার্থবাদী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর খ-িত নজরুলকে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধিতে ব্যবহারের চেষ্টা আর অন্যদিকে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে পূর্ব বাংলার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়া-মহল্লায় ‘রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তজয়ন্তী’ পালনের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনা শাণিত করার বিষয়টিও উঠে এসেছে।
১৯৭২ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ নজরুল কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসেন। ঝোড়ো জীবনের শেষভাগে ঢাকায় অবস্থান, সংবর্ধনা ও কবিকে ঘিরে জনতার বিপুল আগ্রহের কথা সবিস্তার এসেছে বইয়ের শেষ দুই অধ্যায়ে। ঢাকার বাইরে কবিকে প্রদত্ত দুটো সংবর্ধনার কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ দিয়েছেন লেখক:
‘১৯৭৪ সালেই ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইলে ও নারায়ণগঞ্জেও কবিকে দুটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল সেখানকার “শাপলা” নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে রণেশ দাশগুপ্ত, অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী প্রমুখ বক্তব্য দেন। সেদিন কবিকে দেখতে আসা মানুষের ভিড়ের চাপে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের দেয়াল ভেঙে পড়েছিল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার এক বছর পর ১২ই ভাদ্র ১৯৭৬ সালের শোকের মাসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নজরুল।
কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
কবি নজরুল তাঁর ৭৭ বছরের জীবনকালের ৩৪ বছরই ছিলেন নির্বাক (১৯৪২-১৯৭৬)। বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম, অভাব-অনটন, নানা প্রতিকূলতা, জেলজুলুম ও হুলিয়ার মধ্যেই তাঁর সাহিত্যচর্চার সময় ছিল মাত্র ২৪ বছর (১৯১৯-১৯৪২)।
এই ২৪ বছরে নজরুল সৃষ্টি করে গেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার, মতান্তরে ৭ হাজার গানসহ ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ ও ৩টি উপন্যাস গ্রন্থ, ৩টি নাটক, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধ, ২টি কিশোর নাটিকা, ২টি কিশোর কাব্য, ৭টি চলচ্চিত্র কাহিনীসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা।
তাই তো একাধারে তিনি ছিলেন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সঙ্গীতজ্ঞ ও অভিনেতা।

Please Share This Post in Your Social Media






© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Design & Developed BY AMS IT BD