August 25, 2025, 6:18 pm
রাজশাহী মোঃ হায়দার আলী।। বিখ্যাত সুস্বাদু আম বলতে ভোজন রসিকদের কাছে আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবঞ্জের আমের যেমন তুলনা হয়না। তেমনি আরেকটি খাবার দারুন জনপ্রিয়। সেটি হলো চাউল ও মাসকালাইয়ের আটার রুটি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ রাজশাহী আসবেন আর মাস কালাইয়ের রুটি খাবেন না সেকি হয়। এখানকার রসালো শাঁসালো আম মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তি এনে দেয়। একইভাবে পেঁয়াজ-মরিচ খাঁটি সরিষা তেলের ঝাঁজ, ধনে পাতার মেশানো চাটনি কিংবা বেগুনের ভর্তা দিয়ে কালাইয়ের রুটি। গরু হাঁসের মাংশের কালা ভূনা, গরুরবট, আর কিছুই বলার দরকার নেই। এমনিতেই জিভে পানি এসে যায়।
অসাধারণ স্বাদের কালাইয়ের রুটি একবার খেলে বার বার মুখে দিতে মন চাইবে। সাধারণ খাবার হলেও এর স্বাদ আর সুঘ্রানের তুলনা হয় না। হলফ করে বলা যায় যারা এখনো এর স্বাদ নেননি, তারা একবার নিলে মনের অজান্তেই বলে উঠবেন ‘আবার খাবো’। গোদাগাড়ী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী এলেই তুখোড় রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী, উপদেষ্টা এলেই এ রুটির স্বাদ গ্রহন করে থাকেন।
ঐতিহ্যবাহী কলাই রুটি বাসাবাড়ী, ফুটপাত হয়ে স্থান করে নিয়েছে অভিজাত রেস্তোরাঁয়, এমন কি প্রবাসীগণ বিদেশে যাওয়ার এ রুটির উপকরণ নিয়ে যান। সেখানেও স্থান পেয়েছে কলাইয়ের রুটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘কলাই রুটির’ আদি উৎস চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরাঞ্চল। স্থানীয় ভাষায় একে বলে দিয়াঢ়। পদ্মার পলি মাটি মাষকলাই চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। সম্ভবত এ কারণে ‘কলাই রুটি’ ছিল পদ্মার চরের মানুষের সকালের লাহারি (নাস্তা)। পুরুষরা ভোরে মাঠের কাজে গেলে বধূরা ‘কলাই রুটি’ লাহারি কাপড়ে মুড়িয়ে পরম যত্নে মাঠে নিয়ে যেতেন। ‘কলাই রুটির’ কারণে অন্য অঞ্চলের মানুষরা। তারা কৃষি শ্রমিকদেরও মাঠের মধ্যে সকালের নাস্তা, দুপুরেও খেতে দিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষদের রসিকতা করে ‘কলাই’ সম্বোধন করতেন। সেই ‘কলাই রুটির’ জনপ্রিয়তা এখন রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল জুড়ে। আগে শীতকালে ‘কলাই রুটি’ খাওয়ার প্রচলন থাকলেও এখন বছর জুড়েই খাওয়া হয়।
কালক্রমে ‘কলাই রুটি’ চর থেকে শহরের ফুটপাত হয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ঠাঁই নিয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলের যে কোনো উৎসবের প্রিয় খাবার এখন ‘কলাই রুটি’। এ রুটি খেলে খিদে কম লাগে।
এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় জানা যায়, দিন দিন বাড়ছে কলাই ডালের চাহিদা ও দাম। আগের মতো কম দামে কলাইয়ের ডাল পাওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও দামের কারণে কলাই রুটিতেও এখন ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। মেশানো হচ্ছে কালি কলাই আর মুগডাল। ফলে অনেক জায়গার ‘কলাই রুটিতে’ আগের স্বাদ নেই। ‘কলাই রুটির’ আসল স্বাদ চাইলে বাজার থেকে কলাই কিনে রোদে শুকিয়ে মেশিনে ভাঙিয়ে নেওয়াই উত্তম বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলে এসে ‘কলাই রুটির’ স্বাদ নেননি, খুঁজলে এমন মানুষ হয়তো কমই পাওয়া যাবে। অন্যদিকে বাইরের মানুষ এখানে এসে ‘কলাই রুটির’ স্বাদ নেন না, এমনটি যেনো হতেই পারে না। তাইতো সাধারণ থেকে সেলিব্রিটিরা পর্যন্ত ‘কলাই রুটির’ স্বাদ নিতে ভুল করেন না।
‘কলাই রুটি’ বানানো কিন্তু খুব সহজ নয়। মাসকলাই ও চালের গুঁড়ার সঙ্গে স্বাদমতো লবণ ও পানির মিশ্রণে তৈরি খামিরের বল, দুই হাতের তালুর চাপে ঘুরিয়ে ‘কলাই রুটি’ বানাতে হয়। সাধারণ রুটির চেয়ে কলাই রুটি অধিক পুরু ও বড়ো আকৃতির হয়। এ রুটি মাটির খোলা কিংবা পাত্রে (তাওয়া) সেঁকে বাদামি রঙের হলে নামিয়ে পরিবেশন করতে হয়। সাধারণত গরম গরম ‘কলাই রুটি ঝাল-পেঁয়াজ ও পোড়া বেগুনভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়। এক্ষেত্রে অতিসাম্প্রতিক সংযোজন হলো ভুনা হাঁসের মাংস ও গরুর দিয়ে কলাই রুটি খাওয়া। সৌখিনরা বাড়িতে মেহমানদের পছন্দমতো গরু, খাসি কিংবা মুরগি ভুনার সঙ্গে কলাই রুটি পরিবেশন করেন। রাজশাহী অঞ্চলে প্রতিটি কলাই রুটির দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। অর্ডারে তৈরি স্পেশাল কলাই রুটি সর্বোচ্চ ৩০/৪০ টাকা, সঙ্গে কাঁচামরিচ বা ধনেপাতা বাটা ও পেঁয়াজ কুঁচি ফ্রি। পোড়া বেগুনভর্তার দাম ১৫ – ২০টাকা।
কালাইয়ের রুটি এখন সবার প্রিয় খাবারের স্থান নিয়েছে। শুরুতে বাসাবাড়ী তারপর ফুটপাতে থাকলেও এই রুটি হোটেল রেস্তোঁরায় ঠাঁই নিয়েছে।
এক সময়কার ফুটপাতে কালাই রুটির কারবার থাকলেও এখন আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে এর রেস্তোঁরা। শুধু কলাইয়ের রুটি আর ঝাল ভর্তার পাশে হাঁসের মাংস মেলে। পরিবেশনাতেও এসেছে ভিন্নতা। ঝাল চাটনি ও বেগুন ভর্তার পাশপাশি আচারসহ বিভিন্ন জিনিস থাকছে। তবে কলাই রুটির সাথে পেঁয়াজ মরিচের চাটনি আর বেগুন ভর্তাই মানানসই। আর ভোক্তাদের নজর ওইদিকেই।
কলাই রুটি বিক্রি করে অসংখ্য অসহায় নারী তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছে। যে কলাইয়ের রুটি নিয়ে এতো কথা, সেটি বানানো সবার সহজ নয়। আটার রুটি ময়দা দিয়ে পরোটা তন্দুরি কিংবা নানরুটি খুব সহজেই কাঠের পিড়িতে বেলে তাওয়া আর তন্দুরে সেঁকে নেয়া যায়। কিন্তু কলাইয়ের রুটি কাঠের বেলুন পিড়ি কিংবা রুটি মেকারে বানানো সম্ভব নয়।
অন্যান্য রুটির ন্যায় কলাইয়ের আটার গোল গোল বল দুই হাতের তালুর চাপে চাপে বনে যায় রুটি। এই রুটি বানাতে হলে প্রয়োজন কালাইয়ের মিহি আটা। যদি যাঁতায় পেষানো যায় তবে খুবই ভাল। এই আটার সাথে আতপ চালের কিছুটা মিশ্রন দেয়া হয় মচমচে করার জন্য। মাটির তাওয়ায় এপিট ওপিঠ সেঁকতে হয়। চুলার ধারে বসে গরম গরম রুটির স্বাদই আলাদা।
এখানেও ঘটেছে ভেজালের মিশ্রন। তাই সেই আগের মত এর স্বাদ পাওয়া যায় না। প্রকৃত স্বাদ নিতে হলে আগে বলে বানিয়ে নেয়াই ভাল। বাড়িতে নিজেরাও চেস্টা করে দেখতে পারেন। খাঁটি মানের কালাইয়ের রুটি বা ডাল তৈরির সময় এর মনকাড়া সুগন্ধ অনেক দূর থেকে ভেসে আসে।
কালাই রুটির আদি উৎসভূমি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চল। যাকে বলে দিয়াড়। এটি ছিল নি¤œবিত্ত মানুষের খাবার। সকালে এটি দিয়ে লাহারী খাওয়া (নাস্তা) হয়। কৃষকরা ভোর বেলায় মাঠে গেলে কৃষাণ বধূ লাহারী বানিয়ে কাপড়ে মুড়িয়ে পরম যতেœ নিয়ে যায় মাঠে কৃষকের কাছে। এটি খেলে পেটে অনেকক্ষণ থাকে বলে ক্ষিধে কম লাগে। আবার পুষ্টিমানের দিক দিয়েও অনন্য।
জাতীয় অথবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় কর্মীরা খাবার হিসেবে গামছা কিংবা কাপড়ে বেঁধে কালাই রুটি অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। এই রুটির কারনে এক সময় রসিকতা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষকে ‘কালাই’ বলে সম্বোধন করা হতো। আর সেই কালাইয়ের রুটির জনপ্রিয়তা এখন দেশ-বিদেশে। কালাই বলে সম্বোধন করলে আগে বিব্রত হলেও এখন গর্ব অনুভব করে।
কালাইয়ের ডাল কি রসনা মেটায় না?
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে এর গুণও অনন্য। এতে রয়েছে শতকরা কুড়ি থেকে পঁচিশ ভাগ আমিষ। প্রোটিন ও ভিটামিন বি এর অন্যতম উৎস্য। রুচিকর ও বল বর্ধক। পুরুষের শুক্রানু বাড়ায়। রয়েছে প্রচুর আয়রণ। প্রচুর ফাইবার আছে বলে হজম ভালো হয়। কোষ্ঠ্য কাঠিন্য দূর করতে বেশ উপকারি। হার্ট ভাল রাখে। কোলস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাকৃতিক উদ্দীপক হিসাবে এ ডাল ভাল কাজ করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং ব্যাথানাশক। সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ত্বকের যত্নে দারুণ কাজ করে। রোদে পোড়া ত্বক, মুখের দাগ, ব্রনসহ নানা রোগের উপশম করে। এ ডাল মুখে মাখলে চুলের খুশকি দূর হয় আর চুলও নরম হয়। কালাইয়ের ডাল স্বাদ ও গন্ধে অনন্য। তৃপ্তিসহ ভাত খেতে চাইলে এ ডাল খেয়ে দেখতে পারেন। দিন দিন বাড়ছে কালাইয়ের ডালের চাহিদা ও দাম। আগে সবচেয়ে কমদামি ডাল ছিল এটি। আর এখন হয়েছে উল্টো। সবচেয়ে বেশি দামি ডাল এটি।
সিসিবিভিওর কর্মকর্তা নিরাবুল ইসলাম বলেন, কলাইয়ের রুটি, কাঁচা মরিচের লবন, বেগুন ভর্তা, হাঁস ও গরুর মাংশের ভুনা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। দূরদুরান্ত থেকে রুটি খেতে আসে আসেন। রুটি সম্মতভাবে খায়।
নাম প্রকার না করা শর্তে একজন এমবিবিএস ডাক্তার বলেন, কলাইয়ের রুটি সুস্বাদু খাবার, দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষুদা নিবারণ হয়। পেটের সমস্যা দূর হয়। ডায়বেটিক নিয়ন্ত্রন থাকে।
চাহিদা আর দামের কারনে এরমধ্যে আবার ভেজাল অনুপ্রবেশ করেছে। মেশানো হচ্ছে কালিকালাই আর মুগডাল। ডাল কিংবা কালাইয়ের রুটির আসল স্বাদ নিতে হলে বাজার থেকে কালাই কিনে ভেঙে ডাল কিংবা আটা করাই উত্তম। আগে কালাইয়ের রুটি শীতকালে বেশি খাওয়া হলেও এখন বছরজুড়েই চলছে।
কালাই রুটির অপকারিতারঃ কালাই রুটি খেলে কিছু অপকারিতার মধ্যে রয়েছে হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি এবং গ্যাস হতে পারে। গ্লুটেন সংবেদনশীল ব্যক্তি বা যারা সিলিয়াক রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্য কালাই রুটি ক্ষতিকর হতে পারে। এছাড়া, পরিমিত পরিমাণে না খেলে বা রুটি তৈরির সময় অতিরিক্ত পরিশোধিত উপাদান ব্যবহার করলে এটি স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হতে পারে।
মোঃ হায়দার আলী
নিজস্ব প্রতিবেদক,
রাজশাহী।