August 10, 2025, 2:21 pm
উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:
বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী নড়াইলে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপিত হয়েছে। উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি জানান, রোববার (১০ আগস্ট) সকালে জেলার মাছিমদিয়ায় শিল্পীর সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া মাহফিল ও কোরআনখানি আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
এ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, নড়াইল প্রেসক্লাব, এস এম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন, এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা, লাল বাউল সম্প্রদায়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়, জুলাই যোদ্ধা কাউন্সিল, মুর্ছনা সংগীত নিকেতন, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন সংগঠন শিল্পীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায়।
জেলা প্রশাসন ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ আয়োজন করে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি শারমিন আক্তার জাহান। তিনি বলেন, “এস এম সুলতান শুধু নড়াইল বা বাংলাদেশের নয়, তিনি বিশ্বের শিল্পভুবনে এক অনন্য নাম। তাঁর শিল্পকর্মে গ্রামীণ জীবন, কৃষকের সংগ্রাম ও মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। নতুন প্রজন্মের কাছে সুলতানের জীবনদর্শন ও শিল্পচেতনা পৌঁছে দিতে আমাদের আরও উদ্যোগ নিতে হবে। নড়াইলের গর্ব এই মহামানবকে স্মরণ করা মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন ও বিকশিত করার অঙ্গীকার।
বিশেষ অতিথিদের মধ্যে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) লিংকন বিশ্বাস, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক জুলিয়া সুকাইনা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন, এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন সিকদার, নড়াইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রশিদ লাবলু, সিনিয়র সহ-সভাপতি আজিজুল ইসলাম ও সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সিদ্দিকী। এছাড়া এস এম সুলতান চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি শেখ হানিফসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অংশ নেন।
শৈশবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন বেশি দূর এগোয়নি, কিন্তু শিল্পের প্রতি গভীর আগ্রহ তাঁকে ঢাকা এবং পরে কলকাতায় নিয়ে যায়। ১৯৪৪ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেও স্নাতক সম্পন্ন করার আগেই তিনি সৃজনশীল স্বাধীনতার টানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপথ ছেড়ে দেন। এরপর তিনি ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নানা শহরে চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করেন।
শিল্পে কৃষিজীবী মানুষের গৌরব
এসএম সুলতানের ক্যানভাসে সর্বদাই গ্রামীণ কৃষিজীবী মানুষের প্রাণবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। সুঠাম দেহের কৃষক, বিস্তৃত ধানক্ষেত, গবাদি পশু— তাঁর তুলির টানে গ্রামীণ জীবন হয়ে উঠেছে মহিমান্বিত ও বীরত্বমণ্ডিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের শক্তি ও ভবিষ্যৎ নিহিত আছে মাটির মানুষ ও কৃষিজীবী সমাজের হাতে।
শিল্প সমালোচকদের মতে, সুলতানের কাজ কেবল দৃশ্যপট নয়, বরং তা এক ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য। শিল্পের মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও আত্মমর্যাদাকে তুলে ধরেছেন, যা তাঁকে ‘মাটি ও মানুষের চিত্রশিল্পী’ উপাধি দিয়েছে।
অর্জন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৪ সালে রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা লাভ করেন। আন্তর্জাতিকভাবে, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ম্যান অব দ্য ইয়ার উপাধিতে ভূষিত করে, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার প্রদান করে ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা ঘোষণা করে ম্যান অব এশিয়া।
নড়াইলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সুলতান
জীবনের শেষভাগে তিনি নড়াইলে ফিরে এসে শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ‘শিশু স্বর্গ’ এবং ‘সুলতান সংগ্রহশালা’। এখানে শিশুদের ছবি আঁকা, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করেন। নড়াইল শহরের কুড়িগ্রাম এলাকায় সুলতান সংগ্রহশালায় এখনো তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম, ব্যবহৃত উপকরণ ও ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এসএম সুলতান। জন্মভূমি নড়াইল শহরের কুড়িগ্রাম এলাকায় সংগ্রহশালা চত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর তিন দশক পরও তাঁর কাজ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে, আর তাঁর তুলির আঁচড়ে আঁকা মানুষগুলো বেঁচে আছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনায়।
জন্মবার্ষিকীর কর্মসূচি
সুলতানের ১০১তম জন্মদিন উপলক্ষে আজ সকালে কোরআন খতম, তাঁর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং আলোচনাসভাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পপ্রেমী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিল্পানুরাগীরা।
নড়াইলবাসীর গর্বের প্রতীক এসএম সুলতান শুধু একজন শিল্পী নন—তিনি বাংলার মাটি, মানুষ এবং শিল্পচেতনার অবিনাশী প্রতীক। উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি।