August 9, 2025, 6:53 pm
রাজশাহী থেকে মোঃ হায়দার আলীঃ রাজশাহীর রাজবাড়িহাট আঞ্চলিক দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে দাপটের সঙ্গে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে আওয়ামীপন্থি ঠিকাদার সিন্ডিকেট। দলটি প্রধান ফ্যসিট হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলেও দেশের অন্যতম বৃহৎ এ পশু খামারটিতে খাদ্য সরবরাহের টেন্ডার এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে এ প্রভাবশালী চক্রটি। গত পাঁচ অর্থবছরে এ সিন্ডিকেটটি কম দামের নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ১৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ীতে দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারটি বরেন্দ্র অঞ্চলের গো-খামারিদের আশার আলো দেখালেও টেন্ডার সিন্ডিকেটের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে খামারটি। গরুর প্রসিদ্ধ জাত শাহীওয়াল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করছে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ীতে অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত খামারটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহীওয়াল জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ছাড়াও পুষ্টিসমৃদ্ধ দুধ সরবরাহ, মাংসের ঘাটতি মেটাতে এঁড়ে বাছুর বিক্রি, উন্নত জাতের ঘাস চাষ সম্প্রসারণ করছে এ খামার।
রাজশাহীর এ খামারটি স্থাপিত হয় ১৯৬৮ সালে। তখন খামারটি এস্টাবলিস্টমেন্ট অব ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল ব্রিডিং ফার্ম নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭৭ সালে এর নামকরণ হয় নর্দার্ন ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট ফার্ম। ১৭৯ একর জমিতে এ খামার গড়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালে ১৭৮টি গাভী নিয়ে রাজশাহী ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট ফার্ম নামে যাত্রা হয় এ খামারের।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ খামারে বর্তমানে ৩৫৪টি গবাদিপশু রয়েছে। খামারে দৈনিক প্রায় ২২০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। গবাদিপশুর খাদ্যের জোগান আসে খামারের বিশাল এলাকাজুড়ে চাষ করা ঘাসে। দৈনিক ৯-১০ হাজার কেজি ঘাস সরবরাহ হয় খামারে। খামার থেকে দৈনিক এক টন গোবর উৎপাদন হয়। এর একটি বড় অংশ জৈবসার উৎপাদনে ব্যবহার করে খামার কর্তৃপক্ষ। সেই সার ব্যবহার হয় ঘাস চাষে। এছাড়া এ খামার থেকেই বায়োগ্যাস ও জৈবসার প্রস্তুতকারীদের গোবরের জোগান দেয়া হয়। খামারের হিসাবের বাইরে আরো ৪২টি প্রজনন ষাঁড় এআই ল্যাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ ল্যাব থেকে বছরে অন্তত সোয়া কোটি টাকার সিমেন উৎপাদন হয়। কিন্তু আওয়ামী টেন্ডার সিন্ডিকেটের কারণে কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে খামারটি।
অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও খাদ্য সরবরাহের একটি প্যাকেজের চারটির মধ্যে তিন গ্রুপের কাজের অনুমোদন পেয়েছে আওয়ামীপন্থি সিন্ডিকেটটি। ৮ জুলাই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ড. এবিএম খালেদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। তিনটি গ্রুপে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন না দেওয়ায় সরকারের ৯১ লাখ ৮১ হাজার ৪৭২ টাকা তছরুপ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ তিন গ্রুপের মধ্যে দুটির অনুমোদন রাজশাহী জেলা কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমন মন্ডলের বাবা রবিউল করিমের মালিকানাধীন মেসার্স করিম ট্রেডার্সকে দিয়েছে। মূলত গত এক যুগ থেকে ইমন বাবার পক্ষে করিম ট্রেডার্সের সব কর্মকাণ্ড দেখভাল করেন। ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপন করেছেন। এছাড়া আরেকটি গ্রুপে খাদ্য সরবরাহের অনুমোদন পেয়েছে সাবেক প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের এপিএস হিলটন সাহার মালিকানাধীন এইচএন এন্টারপ্রাইজ।
এদিকে টেন্ডার প্রক্রিয়ার নিয়মানুযায়ী, অনুমোদন পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিককে সশরীরে উপস্থিত হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দেন এইচএন এন্টারপ্রাইজের মালিক হিলটন সাহা। তবে তার পক্ষে নিয়ম ভেঙে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স করিম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রবিউল করিম এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় অন্যান্য ঠিকাদারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করেছে।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্যাকেজের দুই নম্বর গ্রুপে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কানাইডাঙা এলাকার মেসার্স করিম ট্রেডার্সকে আস্ত ছোলা ও রাইস ব্রানসহ অন্যান্য খাদ্য সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। করিম ট্রেডার্স এ সরবরাহে এক কোটি ৩৬ লাখ ৬ হাজার ৪৪৯ টাকা দর প্রদান করে। অথচ টেন্ডারে অংশ নেওয়া সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে রাজশাহীর মেসার্স সদর অ্যান্ড ব্রাদার্স ৬৯ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৫ টাকা প্রদান করেছে। এছাড়া আরও দুটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেতাগা ট্রেডার্স ৭১ লাখ ১৬ হাজার ১৪৮ টাকা এবং এইচএন এন্টারপ্রাইজ ১ কোটি ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩১৪ টাকা দর প্রদান করে। ফলে সর্বোচ্চ দরদাতা করিম ট্রেডার্সকে খাদ্য সরবরাহের অনুমোদন দেওয়ায় ৬৬ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৪ টাকা তছরুপ করা হয়েছে। এর বিনিময়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন খামারটির অসাধু কর্মকর্তারা।
একইভাবে প্যাকেজের তিন নম্বর গ্রুপের আস্ত ভুট্টা এবং লাইম স্টোনসহ অন্য খাদ্য সরবরাহে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে করিম ট্রেডার্সকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ৮৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৩ টাকা দর প্রদান করে। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে মেসার্স বেতাগা ট্রেডার্স প্রদান করে ৬১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৮২ টাকা। আর মেসার্স সদর অ্যান্ড ব্রাদার্সের দর ছিল ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ১৮৮ টাকা। এক্ষেত্রেও সরকারের ২২ লাখ ৬১ হাজার ৪৯৬ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া প্যাকেজের ৪ নম্বর গ্রুপে হিলটন সাহার এইচএন এন্টারপ্রাইজকে ধানের শুকনো খড় এবং ডালের ভুসিসহ অন্য খাদ্য সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দর প্রদান করেছে ৭০ লাখ ৪৯ হাজার ৯৩৭ টাকা। অথচ সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মেসার্স সদর অ্যান্ড ব্রাদার্স দর প্রদান করে ৬৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫৫ টাকা। এক্ষেত্রেও সরকারের তিন লাখ ৫ হাজার ৮২ টাকা তছরুপ করা হয়েছে।
খামারটির সাবেক ঠিকাদার শামসুল খান বলেন, গত পাঁচ অর্থবছর থেকে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের দাপট দেখিয়ে এইচএন এন্টারপ্রাইজ এবং করিম ট্রেডার্স দুগ্ধ খামারের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেছে। কারণ প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের দাপটে আমরা ছিলাম অসহায়। এ কারণে দীর্ঘ সময় কাজ না পেয়ে খামারে ঠিকাদারি বন্ধ করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটি খামারটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে নিম্নমানের কম দামি খাদ্য সরবরাহ করে গত কয়েকটি অর্থ বছরে অন্তত ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পতন হলেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ সিন্ডিকেটটিই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে তাদের সরবরাহের অনুমোদন দিয়ে সরকারি অর্থ তছরুপ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এইচএন এন্টারপ্রাইজ এবং করিম ট্রেডার্স খামারের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে একে অপরের সহযোগী। করিম ট্রেডার্স স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এ কারণে এইচএন এন্টারপ্রাইজের মালিক হিলটন সাহা আত্মগোগনে থাকলেও তার অনুপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষরের জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন করিম ট্রেডার্সের মালিক রবিউল করিম।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, হিলটন সাহার পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আমার কোনো তৎপরতা নেই। এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
সর্বোচ্চ দরদাতাকে খাদ্য সরবরাহের অনুমোদনের মাধ্যমে অর্থ তছরুপ এবং হিলটন সাহার অনুপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষরের তৎপরতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন খামারের উপপরিচালক ড. মো. ইসমাইল হক। তিনি বলেন, ‘আমি টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সদস্য না। যারা এ কমিটির সদস্য তারা বলতে পারবেন। এছাড়া কোনো দলীয় সিন্ডিকেট খামারের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে না। তাদের সঙ্গে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তিনজন কর্মকর্তা মূল্যায়ন কমিটির সদস্য। এ কমিটির অন্যতম সদস্য সহকারী পরিচালক ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘নিম্ন দারদাতাদের অনুমোদন না দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’ এলাকার সচেতন মহল সরজমিনে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য উদ্ধোর্তন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মোঃ হায়দার আলী,
রাজশাহী।