August 6, 2025, 9:30 pm
লেখকঃ মোঃ হায়দার আলীঃ সিংহভাগ মানুষের আক্বীদা-বিশ্বাসের উপর আঘাত হানার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নাস্তিক্যবাদী যে চক্রান্ত অব্যাহত ছিল, তার একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত হ’ল বিগত বছর গুলিতে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। বৃটিশদের চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও কেরানী তৈরি করার লক্ষ্যে নিবেদিত ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দর্শনে পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা এদেশের আম জনমানুষের শাখায়-প্রশাখায় এমনভাবে পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনাদর্শকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, যা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় যেন ছিল না। স্বাধীনতার পর যতগুলো শিক্ষাক্রম এসেছে, প্রতিটি শিক্ষাক্রমেই একটু একটু করে গেড়ে দেয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বীজ, আর পাল্লা দিয়ে কমানো হয়েছে মুসলিম হিসাবে আত্মপরিচয় গঠনের সুযোগগুলো। এ বিষয়ে লিখার জন্য চিন্তা ভাবনা করলাম, কিন্তু টিভি, জাতীয়, স্থানীয়, অনলাইন পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষধর সাপে কামড়ে মানুষের মৃত্যু কয়েকগুন বেড়েছে। রীতিমতো বিভিন্ন এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছু বিষধর রাসেল ভাইপারসহ বিভিন্ন সাপ মানুষ মেরে ফেলেছেন।
বিষধর রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন সাপের কামড়ের বিষাক্ত ছোবলে, ব্যবসায়ী, শিশু, কিশোর, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষার্থীসহ কিছু মানুষ মারা গেছেন এবং এধরনের অনেক সাপকে মানুষ মেরে ফেলেছে যা ফেসবুকে ছবি পোস্ট করছেন। আতঙ্কিত মানুষের কথা চিন্তা করে লিখার থিম পরিবর্তন করে । আল্লাহর নাম নিয়ে বিষধর সাপ সম্পর্কে লিখার চেষ্টা করচ্ছি।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলে, গত কিছুদিন যাবত বিষাক্ত রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে অনেক কয়েকজন আহত হয়েছেন,
গত বছরের এ সময়ের কয়েকগুন বেশী মানুষ মারা গেছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ঝোপঝাড়ে থাকা সাপগুলো লোকালয়ে চলে আসছে। ফলে অনেক এলাকায় সাপের উপদ্রব বেড়ে গেছে। গ্রামের মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাসী হওয়ায় ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে আগে যাচ্ছে। দেরি করে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে সাপে কাটা রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।
রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে যেসব সাপ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিষাক্ত। এই সাপের কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাপের এই প্রজাতিটি বাংলাদেশ থেকে বহু বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবারো এই সাপের কামড়ের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রজাতির সাপ এই অঞ্চলে আবার কীভাবে ফিরে আসছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা চলছে।
কীভাবে ফিরে আসছে রাসেলস ভাইপার : বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও এই সাপ থেকে মানুষের ঝুঁকির বিষয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আহসান মনসুর। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০টি রাসেলস ভাইপার দংশনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে, করা গবেষণাটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইাটি, বাংলাদেশে। সেসময় ঐ গবেষণায় উঠে আসে যে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাতেই রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি রয়েছে। ঐ গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই এই সাপের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। ঐ গবেষণায় উঠে আসে যে এই প্রজাতির সাপের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তবে বর্তমানে আরো বেশি এলাকায় এই প্রজাতির সাপের উপস্থিতি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। মি. আহসান ধারণা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প সংখ্যক রাসেলস ভাইপার সবসময়ই ছিল, কিন্তু বংশবিস্তারের মত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় এই সাপের উপস্থিতি তেমন একটা বোঝা যায়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে এই সাপের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল ফলানো – বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার সময় মন্তব্য করেন ফরিদ আহসান। “আগে কৃষিজমিতে বছরে একবার বা দুইবার ফসল ফলানো হত এবং বাকি সময় পানির অভাব থাকায় জমি পরিত্যক্ত পড়ে থাকতো। ৯০’ এর দশকে সেচ পদ্ধতির উন্নতির সাথে সাথে কৃষকরা বছরে দুই থেকে তিনটি ফসল ফলানো শুরু করেন এবং জমি কম সময় পরিত্যক্ত থাকতে শুরু করে।” “সারা বছর ক্ষেতে ফসল থাকায় জমিতে ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা এই সাপের প্রধান খাদ্য। আর ইঁদুর বাড়ার সাথে সাথে সাপ পর্যাপ্ত খাদ্য পেতে শুরু করে এবং বংশবিস্তারের জন্য যথাযথ পরিবেশ পেতে থাকে,” বলেন মি. আহসান। ঘন ঝোপ আর পরিত্যক্ত জমি অপেক্ষাকৃত কমে যাওয়ায় এই সাপ কৃষি জমিতেই থাকে, যার ফলে যারা মাঠে কৃষিকাজ করেন তারা রাসেলস ভাইপারের দংশনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়ে থাকেন। এছাড়া বর্ষাকালে নদীর পানি বাড়ার ফলে ভারতের নদ-নদী থেকে ভেসেও এই সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে জানান মি. আহসান। “এখন পর্যন্ত পদ্মা অববাহিকায় এই সাপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আমরা দেখেছি যেসব জায়গায় এই সাপ পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ জায়গাতেই কচুরিপানা রয়েছে, আবার কচুরিপানার মধ্যেও এই সাপ পাওয়া গেছে। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি কচুরিপানার ওপরে ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই সাপ বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছেছে।”
মূলত বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতির সবচেয়ে বেশি প্রমাণ পাওয়া গেলেও সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীতেও এই সাপের দেখা মিলেছে বলে জানান অধ্যাপক ফরিদ আহসান। এছাড়া ২০১৪ ও ২০১৫ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি চর এলাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা অন্তত পাঁচটি রাসেলস ভাইপার সাপ অবমুক্ত করা হয়। তবে অধ্যাপক আহসান মনে করেন অবমুক্ত করা অল্প কয়েকটি সাপ বাংলাদেশে এই প্রজাতির সংখ্যা বাড়ানোর পেছনে খুব বেশি ভূমিকা রাখেনি। কতটা
মারাত্মক এই সাপের দংশন: বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের দংশনের হার খুব বেশি না হলেও ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ সর্প দংশনের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে অন্তত ৪৩% এবং শ্রীলঙ্কায় প্রতি বছর মোট সর্প দংশনের ঘটনার ৩০-৪০% রাসেলস ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত কৃষি জমিতে থাকে বলে মানুষ অনেক সময়ই সাপের গায়ে পা দেয় বা না জেনে একে বিরক্ত করে থাকে। আর রাসেলস ভাইপার বিপন্ন বোধ করলে আচমকা আক্রমণ করে থাকে। এই প্রজাতির সাপের কামড়ের কিছুক্ষণ পরই দংশিত স্থানে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যাখ্যার পাশাপাশি দংশিত স্থান দ্রুত ফুলে যায় এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দংশিত স্থানের কাছে শরীরের আরো কয়েকটি অংশ আলাদাভাবে ফুলে যায়।
দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে নিম্ন রক্তচাপ, কিডনি অকার্যকর হওয়া সহ বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ সাপের দংশনে দংশিত হয়, যার মধ্যে প্রতি বছর অন্তত এক লাখ মানুষ মারা যায়। আর সাপের দংশনে আহত হয়ে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষের অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করেন। সংস্থাটির ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং বছরে অন্তত ছয় হাজার মানুষ মারা যান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে হাসপাতালে সাপের ছোবল খেয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ২৪ হাজার ৪৩২ জনের মধ্যে ১১৮ জন মারা গেছেন। পরিসংখ্যান আরও বলছে, সাপের ছোবলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বরিশালে, তবে মৃত্যুর হার বেশি পদ্মাপাড়ের বৃহত্তর ফরিদপুর ও রাজশাহীতে, যেখানে বিষধর সাপ বেশি দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর সাপের কামড়ে মারা যাওয়া রোগীদের অধিকাংশকেই প্রথমে ওঝা বা বৈদ্যর কাছে নেওয়া হয়েছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা নিলে এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগীকেই বাঁচানো যেত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর ৪ লাখেরও বেশি মানুষ সাপের ছোবলের শিকার হন, যার মধ্যে প্রায় ৯৬ হাজার ৫০০টি বিষধর সাপের ছোবল। এই বিষধর সাপের ছোবলে বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের ছোবলে এই ভয়াবহ মৃত্যুর হার দেশের স্বাস্থ্য খাতে এক নীরব সংকট তৈরি করেছে। তারা বলছেন, সাপের ছোবলে আক্রান্তদের ২০ থেকে ২২ শতাংশের মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো সমন্বিত চিকিৎসার অভাব এবং সময়ক্ষেপণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে না গিয়ে ওঝা বা বৈদ্যের শরণাপন্ন হন।
বিষধর সাপের এর দংশনে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়। কালাস, গোখরা এবং রাসেলস ভাইপারের কামড়ে অ্যান্টিভেনম নিতেই হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক জানান, সাপের ছোবলের ঘটনা বেশি ঘটে বর্ষাকালে, অর্থাৎ—জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে। আর সাপের প্রজনন মৌসুম ‘অক্টোবর’ মাসে। দেশে এই দুই সময়ে সাপের ছোবলের ঘটনা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমগুলো শত বছরের পুরোনো প্রযুক্তিতে তৈরি এবং দক্ষিণ ভারতের চার ধরনের সাপ থেকে সংগৃহীত বিষে তৈরি হওয়ায় সব ধরনের সাপের বিষের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর নয়। অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও ২০ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়।
পদ্মার চরাঞ্চলে ভয়ংকর রাসেল ভাইপারের উপদ্রব, রাসেল ভাইপার সম্পর্কে বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলা বলেন, “আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। এটি ইঁদুর ও টিকিটিকি খায়। বসতবাড়ির আশেপাশে এদের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেলস ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে কখনও কখনও আক্রমণও করে।”
এ সাপ চেনার উপায়, বিষদাঁত, আক্রান্ত রোগির অবস্থাঃ বাংলাদেশের অত্যন্ত বিষধর সাপের মধ্যে একটি দেশে যতগুলি বিষধর সাপ আছে তার মধ্যে একটি রাসেলস ভাইপার। এটি ‘চন্দ্রবোড়া’ নামেও পরিচিত।
রাসেল ভাইপারের কামড়ে ৯০ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বিষধর এই সাপটি চিনতে না পারায় চিকিৎসা নিতে দেরি করায় মৃত্যর ঘটনা বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বে প্রতি বছর সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কেবল এ সাপের কামড়েই মারা যায়। বিশ্বজুড়ে রাসেলস ভাইপারের দুর্নাম রয়েছে।
ভারতের মোদিনীপুর বিষয়ক ওয়েবসাইট মিডনাপুর ডট ইন-এর বন্যপ্রাণী বিষয়ক উপদেষ্টা রাকেশ সিংহ দেব বিস্তারিত একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন এ সাপের ওপর। সাপটির শনাক্তের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, রাসেলস ভাইবার সাপের দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু হয়ে থাকে। মাথা চ্যাপ্টা ত্রিকোণাকার। মাথার তুলনায় ঘাড় অনেকটাই সরু। শরীরের রঙ বাদামি, হলদে বাদামি অর্থাৎ কাঠ রঙের হওয়ায় শুকনো পাতার মধ্যে এই সাপ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। সাপটির জিহ্বার রঙ বাদামি বা কালো। সারা গায়ে স্পষ্ট বড়ো গাঢ় বাদামি গোলগোল দাগ থাকে, এই দাগগুলোর মাথা ছুঁচালো। অনেকসময় দাগগুলো একসঙ্গে দেখতে শিকলের মতো লাগে। গোলাকার দাগগুলো দেখতে অনেকটাই চাঁদের মতো। দাগগুলোর চারপাশে কালো রঙের বর্ডার থাকে, তার মধ্যে সাদা বা হলুদের ছিটে লক্ষ্য করা যায়। পেটের দিকের আঁশ এর রঙ সাদা। এদের বিষদাঁত লম্বা। বিষদাঁতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫-১৬ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাসেলস ভাইপারের বিষদাঁত পৃথিবীতে দ্বিতীয় সবচেয়ে বৃহৎ দাঁত।
গায়ের রঙ এবং প্যাটার্নের মিল থাকায় অনেকেই বিষহীন বালুবোড়া সাপের সঙ্গে বিষাক্ত রাসেলস ভাইবারকে গুলিয়ে ফেলেন। এছাড়া অনেকে ছোট অজগর ভেবে ভুল করেন। কিন্তু ভালো করে পর্যালোচনা করলে সহজেই সাপ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা যায়।
সাধারণত সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, কিন্তু রাসেলস ভাইপার সাপের স্বভাব ঠিক উল্টো। এরা সচরাচর পালিয়ে যায় না। নিজেদের বিপন্ন মনে করলে আক্রমণ করে বসে। বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেলস ভাইপারের অবস্থান পঞ্চম। কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে এর অবস্থান প্রথম। আক্রমণের ক্ষেত্রে এই সাপ এত ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের ভেতরে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে।
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, রাসেলস ভাইবার সাপের কামড়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা কয়েক ঘণ্টা পরে শুরু হতে পারে। প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার বিষয়টি কামড়ের গভীরতা, বিষের মাত্রা, সাপের দৈর্ঘ্য ও বয়সের ওপর নির্ভর করে।
মিডনাপুর ডট ইন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাসেল ভাইবার সাপের কামড়ে তীব্র জ্বালাযন্ত্রণা শুরু হয়। কামড়ের জায়গা দ্রুত ফুলতে থাকে, দংশনের স্থান থেকে চুঁইয়ে রক্ত বের হতে পারে। চোখের কোণ, দাঁতের মাড়ি, নাক বা যে কোনো কাটা অংশ থেকে, থুতুর সঙ্গে, বমি, প্রস্রাব বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। চোখ লাল হয়ে যায়, কোমরের দিকে ও পাঁজরের নিচের দিকে ব্যথা শুরু হয়। সারা শরীর বিশেষ করে পা ফুলতে থাকে।
সাপে কামড়ালে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থাকতে হবে। যে জায়গা কামড়েছে, সেই জায়গা খুব বেশি নড়াচড়া করানো যাবে না। সাপে কামড়ানোর পর প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়ের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। যেহেতু রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে রোগীর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই রোগীকে এমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত যেখানে ডায়ালাইসিসের সুব্যবস্থা রয়েছে।
৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১০ ঘটিকার সময় বিষধর কালাচ সাপের কামড়ে নাটোরের রামশার কাজীপুর কান্দিপাড়া নলডাঙ্গা এলাকার মোঃ নসির উদ্দিন কালুর দ্বিতীয় ছেলে কৃষক মোঃ মিজানুর রহমান (মিনু) (৩৫) বৈকাল ৬টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করিয়াছেন।
সাপটি যখন তাকে কামড়ায় সে নিজে হাতে সাপটিকে মেরেছে। আবার সেই সাপটিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অথচ সে নিজেও বুঝতে পারেনি যে এই সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হবে সে।। পাট খেতে পাট কাটার পর পানিতে দেওয়ার জন্য মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছিল। পাটের আটির মধ্যেই সাপটি ছিল। তখন সাপটি তাকে কামড় দেয়। আর সাপটিকে নিজেই হাতেই মেরে বাড়িতে আনে।
গত ২ আগষ্ট শনিবার চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় সাপের কামড়ে নায়মা খাতুন ( ১৩) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। সে আনোয়ারার রায়পুর ইউনিয়নের সরেঙ্গা গ্রামের বক্সি মিয়াজিবাড়ির মোহাম্মদ হাসানের মেয়ে। সে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে মা ও ছোট বোনের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল নাঈমা। রাত তিনটার দিকে সাপের ছোবলে তার ঘুম ভাঙে। বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের জানালে তাকে উদ্ধার করে রাতেই আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তবে ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক নাঈমাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ১ আগষ্ট চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় বিষধর সাপের কামড়ে মুহাম্মদ তাওসীব (১৬) নামের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। ওই দিন সন্ধ্যায় বাড়ির উঠানে তাকে সাপে কামড় দেয়। তাওসীব উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়নের সড়াইয়া গ্রামের পল্লি চিকিৎসক মো. ইব্রাহিমের ছেলে।
গত ৩০ জুলাই কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বিষধর সাপ ধরতে গিয়ে সেই সাপের কামড়েই এক সাপুড়ের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত ওই সাপুড়ের নাম বয়েজ উদ্দিন। তিনি ওই ইউনিয়নের ডাক্তার পাড়া এলাকার বাসিন্দা।’
স্থানীয়রা জানান, ওই দিন সকালে ইমরান আলীর বাড়িতে একটি বিষধর সাপ দেখতে পায় পরিবারের লোকজন। পরে সাপটি ধরতে স্থানীয় সাপুড়ে বয়েজ উদ্দিনকে খবর দেয়া হয়। খবর পেয়ে সাপুড়ে ওই বাড়িতে এসে স্থানীয়দের সহায়তায় বিষধর সাপটি ধরে। বেশ কিছুক্ষণ লেজ ধরে সাপটিকে ঝুলিয়ে রাখার পর বস্তুায় ভরানোর সময় হাতে কামড় দেয় তার। এর কিছুক্ষণ পর শরীরে বিষোক্রিয়া শুরু হলে হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১ দিনে সাপের কামড়ে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।
গত ৯ জুলাই বুধবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে বাড়ির পাশে জমিয়ে রাখা বালু আনতে যান। সেখানে একটি সাপ শাহিদা বেগমকে ছোবল মারে। হাসপাতালে না নিয়ে তাকে নেওয়া হয় দেড় কিলোমিটার দূরে এক ওঝার কাছে। বিষ নেই বলে ওঝা তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। তারপর বিষক্রিয়ায় ছটফট করতে থাকলে তাকে নেওয়া হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শাহিদা চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের আব্দুল্লাহীল কাফির স্ত্রী।
শুধু শাহিদা নন, এমন অসচেতনতার ফলে ১১ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত জেলার তিন উপজেলায় সাপের ছোবলে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের ভিম কুমার ঘোষ নামের এক যুবক ১১ জুলাই দুপুরে বাড়ির পাশে জমিতে ঘাস কাটছিলেন। হঠাৎ তাকে একটি সাপ ছোবল মারে। তারপর বাড়িতে ফিরে প্রতিবেশী এক ওঝার কাছে যান তিনি। খবর পেয়ে ভিমের মামাতো ভাই কমলেশ কুমার ওরফে মিলন তাকে নিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। কিছুক্ষণ পরই মৃত্যু হয় ভিমের। মিলন বলেন, দেরি করে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। ১৫ জুলাই গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পৌর এলাকার ধুলাউড়ি মহল্লার আবেদ আলী, ১৯ জুলাই একই উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের টিকরামপুর গ্রামের নাইমা খাতুন নামের এক গৃহবধূ, ২১ জুলাই সদর উপজেলার গোবরাতলা এলাকায় গুনির মোড়ে নাচোল উপজেলার সানপুর গ্রামের কাসেম আলী, একই দিন সদর উপজেলার ঘুঘুডিমা এলাকার কৃষক রুস্তম আলী এবং ২৩ জুলাই নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের রেললাইন পাড়ার লতিফা খাতুনের মৃত্যু হয় সাপের ছোবলে।
গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও নাচোল উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একই দায়িত্বে (অতিরিক্ত দায়িত্ব) থাকা ডা. আব্দুল হামিদ বলেন, জুলাই মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছিল। তারমধ্যে একজনকে রেফার করা হয়। আর একজন মৃত রোগী এসেছিল, বাকিরা সুস্থ হয়েছে।
গতবছর ৬ মে রাসেল ভাইপারের দংশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। নিহত শিক্ষার্থীর নাম শাকিনুর রহমান সাব্বির। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ছিল রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায়। এ বিষয়ে সাব্বিরের বন্ধু রাকিবুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মাগরিবের নামাজ শেষে কয়েক বন্ধু মোক্তার বাজার সংলগ্ন পদ্মার পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেখানে সবাই জিলাপি খাচ্ছিলাম। জিলাপি খাওয়া শেষে আমাদের মধ্যে একজন কাগজের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে দেয়। সাব্বির হাত মোছার জন্য ঐ প্যাকেটের কাগজটা তোলার সময় বিষধর রাসেল ভাইপার তাকে কামড় দেয়। তখন সাপটিকে মেরে আমরা বন্ধুরা তাকে আধাঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু শেষমেশ তাকে আর বাঁচানো গেল না। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহম্মেদ বলেছিলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী মারা গেছেন তার মৃত্যুর কারণ রাসেল ভাইপার সাপের দংশন। এই সাপে কাউকে দংশন করলে তার বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। তবে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোদাগাড়ী ইউনিয়নের চম্পকনগর গ্রামের বাসিন্দা সামাউন গত (৫ মে বুধবার) পদ্মা নদীর ওপারে পাঁকা ধান কাটতে গিয়ে রাসেল ভাইপারের কামড়ে সাথে সাথে তার মূত্যু হয়।
গত বছর ৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলায় বিষধর ‘রাসেলস ভাইপার’ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে মো. বিশা প্রামাণিক (৫৪) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সাপের কামড়ের এক মাস ছয় দিন পর তিনি মারা যান। ফরিদপুর, ঢাকার হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছেন কৃষক বিশা প্রামাণিক। তিনি চরভদ্রাসন উপজেলা সদর ইউনিয়নের টিলারচর গ্রামের ডেঙ্গুর প্রামাণিকের ছেলে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এই সাপের আক্রমণ বেশী হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সে এলাকার মাটি এবং রাসেল ভাইপারের গায়ের রঙ প্রায় এক তাই অনেক সময় না দেখেই মানুষ কাছে চলে যায়। এই সাপকে দেখলে নিরাপদে সরে যাওয়াই উত্তম তবে কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে এর থেকে বাঁচা সম্ভব। আশেপাশের পুরাতন পরে থাকা গাছের নিচে খেয়াল না করে হাত না দেওয়া। ধান কাটার সময় গামবুট ব্যাবহার করা।
ধান কাটা শুরুর আগে হাড়ি-পাতিল বা অন্য কিছু দিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করা যেন সে ভয়ে পালিয়ে যায়। যেহেতু এরা খুবই হিংস্র তাই যে সব এলাকায় বেশী দেখা যায় সে সব এলাকায় সচেতনভাবে চলাফেরা করা এবং উপস্থিতি লক্ষ্য করলে সামনে থেকে সরে যাওয়া। রাসেল ভাইপার খুবই হিংস্র এদের থেকে বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে।