August 5, 2025, 2:43 pm
মোঃ তরিকুল ইসলাম তরুন, জেলা প্রতিনিধি,
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর বাজারের একমাত্র লঞ্চঘাটটি প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য বহন করছে। এই ঘাটে আর মসজিদ ঘাটে
একসময় উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব, দঃ অঞ্চলের অর্থকরী ফসল পাট, ধান,চাল,বাদাম, সরিষা, তিল, গম,মুশুরী,কলাই মটর,সুটকি, নানা পণ্য আমদানি-রপ্তানি হতো, এখানে বর্ষামৌসুমে টলার ও নৌকার ভিড়ে আধাকিলোমিটার পর্যন্ত তিতাস নদী তে প্রায় ১ কিঃ মিঃ সারি সারি কোশা, কবুত,সরাং নৌকাসহ দূরদূরান্ত থেকে গহনা বড় নৌকা আসতো বানিজ্য করতে।
সেই রামচন্দ্রপুর লঞ্চঘাট এখন তার জৌলুস হারিয়ে ফেলছে , প্রায় ১ কিঃমিঃ বাজারটি সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার হাট বসতো এখানে ঢাকার সদরঘাট, নারায়নগঞ্জের নিতাইগঞ্জের ঘাট,নরসিংদীর লঞ্চ ঘাট,ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার গোপন ঘাট,জীবনগঞ্জঘাট,ব্রাঞ্চারামপুরঘাট,রামকৃষ্ণপুর ঘাট,হোমনালঞ্চঘাট, ভৈরব লঞ্চ ঘাট থেকে লঞ্চ আসতো এবং ঘন্টা ঘন্টা পর ছেড়ে যাইতো বিভিন্ন স্থানে।
তিতাস নদীর নাব্যতা সংকট, দখল, দূষণ, এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এটি এখন তার সৌন্দর্য, রূপ হারিয়ে গেছে।
এই ঘাটের বর্তমান করুণ দশা কেবল যাত্রী দুর্ভোগই সৃষ্টি করছে না, বরং একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের বিলুপ্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন গভীরতা তিতাস নদী তে না থাকায়
হারিয়ে যাওয়া জৌলুস ও বর্তমান দুর্দশা তিতাস নদীর।
রামচন্দ্রপুর বাজার, যার তিনশ’ বছরেরও বেশি ঐতিহ্য রয়েছে, তার পাশেই অবস্থিত এই লঞ্চঘাটটি একসময় সারাদিনই বড়-ছোট লঞ্চ ও নৌকার আনাগোনায় মুখরিত থাকত। বর্ষা মৌসুমে অনেক সময় নৌকা বাইচ হতো এই নদীর উপর, মানুষের ভীর থাকতো নদীর দুকিনার।
মাত্র ৭ বছর আগেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন রুটে ১২টি লঞ্চ এই ঘাট থেকে ছেড়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে মাত্র দুটি লঞ্চ চলাচল করে, যা সপ্তাহে একবার। যেখানে একসময় ঘাটে কয়েকটি ভেঁপুর শব্দে সরগরম থাকত, সেখানে এখন একটি লঞ্চের ভেঁপুর শব্দ বিউগলের করুণ সুরের মতো বাজে।
নাব্যতার সংকট ও নদীর মৃত্যু:
তিতাস নদী, যা একসময় মাছে ভরপুর ছিল এবং যার বুকে জোয়ার-ভাটা নিয়মিত দেখা যেত, সেই নদী এখন পলি জমে রুগ্ন হয়ে গেছে। খন্ড খন্ড বাঁধ, দখল এবং দূষণের কারণে নদীর নাব্যতা কমে গেছে। এর ফলে বড় লঞ্চ আর আগের মতো ঘাটে ভিড়তে পারে না। এটি শুধু রামচন্দ্রপুর লঞ্চঘাটের জন্যই নয়, পুরো নদীপথের জন্যই একটি অশনি সংকেত।
বয়স্ক ইজারাদারের আক্ষেপ ও অব্যবস্থাপনা:
৭০ বছর বয়সী মোরশেদ মিয়া,জয়নাল মিয়া যিনি গত ৭০ বছর ধরে এই ঘাটে ইজারাদার হিসেবে কাজ করছেন, তার অভিজ্ঞ চোখেই এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে। তিনি জানান, একসময় তিনজন ইজারাদার মিলে টাকা উঠাতো এবং আধা ঘণ্টা পর পর লঞ্চ ছাড়তো। তখন প্রতিটি লঞ্চে শতাধিক যাত্রী উঠতো। এখন তিনি একাই টোল আদায় করেন এবং দৈনিক ৩০ জন যাত্রী পাওয়াও কঠিন। লঞ্চের চেয়ার ও ফ্লোরসহ ৩০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে বর্তমানে একটি লঞ্চ নারায়ণগঞ্জ থেকে দিনে একবার রামচন্দ্রপুর আসে, যা ফিরতেও প্রায় একই সংখ্যক যাত্রী নিয়ে যায়। যেখানে চেয়ার সিটের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা, ফ্লোরের ভাড়া ১৫০ টাকা, সেখানে এখন সামান্য যাত্রীও পাওয়া কঠিন।
যোগাযোগের বেহাল দশা:
ঘাট সংলগ্ন সড়কগুলোর অবস্থাও বেহাল, ফলে যাত্রীদের ঘাটে পৌঁছাতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বাজারের সড়ক ও সংলগ্ন ব্রিজের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ, যা পণ্যবাহী বড় পরিবহন চলাচলের অনুপযোগী। এতে মালামাল পরিবহনে নৌপথ ব্যবহারের সুযোগ কমে গেছে।
প্রশাসনের উদাসীনতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য:
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, রামচন্দ্রপুর লঞ্চঘাটটির আয় কমে গেছে এবং লঞ্চ চলাচল বাড়ানোর বিষয়ে নৌ-পথ পরিচালনা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন। লঞ্চঘাটটির দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্দর কর্মকর্তা বলেন, রামচন্দ্রপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে স্থবিরতা বিরাজ করছে এবং ঢাকা থেকে লঞ্চ চালুর বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জীবন মিয়া মনে করেন, রামচন্দ্রপুর লঞ্চঘাটটি যদি আবারও জমজমাট করতে হয়, তাহলে প্রশাসনকে লঞ্চ চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।নৌ পরিবহন মন্ত্রালয় এগিয়ে আসতেহবে।
রামচন্দ্রপুর লঞ্চঘাট কেবল একটি পরিবহনের কেন্দ্র নয়, এটি একটি অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। তিতাস নদীর নাব্যতা সংকট এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এই ঐতিহ্যবাহী ঘাটের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই লঞ্চঘাটকে বাঁচাতে হলে নদী খনন, দখল ও দূষণ রোধ, এবং একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়মিত লঞ্চ চলাচল নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই হতে পারে এই ঐতিহ্যবাহী লঞ্চঘাটকে তার হারানো জৌলুস ফিরিয়ে দিতে এবং যাত্রী দুর্ভোগ লাঘব করতে।