July 26, 2025, 8:57 am
মোঃ হায়দার আলীঃ রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী তার নাম” এই প্রবাদটি রাজশাহী শহরের নামের পেছনের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থার একটি সুন্দর চিত্র তুলে ধরে। এই প্রবাদটি মূলত বোঝায় যে, একসময় এই অঞ্চলে রাজা-জমিদারদের বসবাস ছিল এবং তাদের নামেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেই রাজা-জমিদার বা তাদের \’শাহী\’ (রাজকীয় প্রভাব) আর নেই, প্রাচীন ঐতিহ্য: “রাজশাহী” নামটি এসেছে “রাজা” এবং “শাহী” শব্দ থেকে, যা ইঙ্গিত করে যে একসময় এই অঞ্চলে রাজা-জমিদারদের আধিপত্য ছিল। সময়ের সাথে সাথে সেই রাজকীয় প্রভাব আর নেই, অর্থাৎ রাজা-জমিদারদের যুগ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু শহরটির নাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বর্তমানে রাজশাহী একটি আধুনিক শহর, পরিচ্ছন্ন শহর যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, এবং আমের জন্য খ্যাতি রয়েছে, কিন্তু “রাজশাহী” নামটি তার ঐতিহাসিক নামের স্মৃতি বহন করে।
এই প্রবাদের সাথে “হাতি ঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম” লাইনটিও খুব পরিচিত। এটি রাজশাহীর আমের প্রসিদ্ধির একটি উদাহরণ।
সুতরাং, “রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী তার নাম” এই প্রবাদটি রাজশাহী শহরের নামের পেছনের ইতিহাস, পরিবর্তন এবং বর্তমান অবস্থার একটি চমৎকার চিত্র ফুটিয়ে তোলে। তবুও এই অঞ্চলের নাম রাজশাহী-ই রয়ে গেছে।
রাজশাহীকে শিক্ষা নগরী, সবুজের শহর, আমরা চিনি তার মসৃণ রেশম, লাল-সবুজ আমের রাজ্য, আর পদ্মা, মহানন্দার শান্ত/অশান্ত স্বরে। কিন্তু রাজশাহীর এই পরিচিতির আড়ালেও লুকিয়ে আছে কিছু হারিয়ে যাওয়া শব্দ, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। তেমনই একটি অনন্য সংস্কৃতির নাম “ঢোপ কল” – এক সময়কার শহরের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আজ যা কেবল স্মৃতি হয়ে আছে প্রবীণদের মনে।
‘ঢোপ’ শব্দটি এসেছে হিন্দি ‘ধোপ’ থেকে, যার অর্থ ধোয়া বা ধোয়ানোর কাজ। আর ‘কল’ মানে কলস বা কলের জলধারা, অর্থাৎ পানি দেওয়ার যন্ত্র। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘ঢোপ কল’ বলতে বোঝায় এক ধরনের পাবলিক পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, যা সাধারণত হাত ঘুরিয়ে বা চেপে পানি বের করার জন্য ব্যবহৃত হতো। প্রায় ৮৭ বছরের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাজশাহীর “ঢোপকল” গুলো। আপনারা হয়ত অনেকেই এর সাথে পরিচিত নন। যারা রাজশাহীতে থাকেন বা গিয়েছেন তারা হয়ত এর সম্মন্ধে জানেন। আমি রাজশাহী শহরে থাকতাম শিক্ষা অর্জনের জন্য। প্রায় ছোট কাল থেকে এ শহর ও ঢোপকলের সাথে পরিচিত। এ ঢোপকলের পানিও পান করেছি এবং বিভিন্ন কাজে ব্যবহারও করেছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহরে গিয়েছি কোথায় আমার দৃশ্য চোখে পড়ে নি। বাংলাদেশের অন্য শহরগুলোতে এমন কোন পানির কল হয়তো আপনাদেরও চোখে দেখিনি।
মূলতঃ এগুলো ১৯৩৭ সালে স্থাপন করা হয়। সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ঘটেছিল তখন। যার ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা-আমাশয় সহ নানারকম পেটের পীড়া। বেশ কিছু লোকেরও নাকি মৃত্যুও ঘটেছিল সেই সময় এই অসুখের জন্য। জনশ্রুতি আছে রাজশাহীর জিরো পয়েন্টের “সোনাদীঘী” খনন করা হয় শুধুমাত্র পানযোগ্য পানি পাওয়ার জন্য। এই দীঘির পানি খুবই টলটলে ছিল। তবে এখন সেই দীঘিটিও নেই।
ঢোপকল গুলো লম্বায় প্রায় ভুমি থেকে ১২ ফিট উঁচু এবং ব্যাস প্রায় ৪ ফিট। ঢোপকল গুলো তৈরী করা হয়েছিল সিমেন্টের ঢালই করে। এই ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো একটা প্লাষ্টার করা হতো। যে নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হতো। এর ঢালাই খুবই শক্ত। সহজে কোন কিছুর ধাক্কায় বা আঘাতে এটা ভাঙ্গে না। এগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সাপ্লাই করা হতো এবং সেখান থেকে এলাকাবাসী সেই পানি সংগ্রহ করতো।
এগুলো তৈরীর সময়ে রাজশাহী পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত। তিনি তখন অনুভব করেন অতিসত্বর এলাকাবাসীর জন্য কিছু একটা করার। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমন পানির কল স্থাপন করার।
রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য গুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ঢোপকলের সঙ্গে রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িত। মহারাণী হেমন্ত কুমারীর প্রচেষ্টা ও অনুদানে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজশাহী বাসীর জন্য সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানি সরবরাহ প্রকল্প মহারাণী হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস নির্মিত হয় যার অন্যতম নিদর্শন রাজশাহী শহরে অবস্থিত এই ঢোপকলসমূহ।
এই ঢোপকল তৈরীর সময়ে রাজশাহী পৌরসভার (বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত। সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ঘটেছিল তখন। যার ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা-আমাশয় সহ নানারকম পেটের পীড়া। বেশ কিছু লোকের মৃত্যুও ঘটেছিল সেই সময় এই অসুখের জন্য।
রায় ডিএন দাশগুপ্ত রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৯৩৪-৩৯) থাকাকালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির কল স্থাপন করা হবে। ১৯৩৭ সালের অগাষ্ট মাসের কোন একটি দিনে মিনিষ্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় এবং ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকা। এই কাজে নগরীর নামকরা ধনী লোকেদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্র ধরেই মহারাণী হেমন্তকুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর নামেই ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপিত হয়। কালক্রমে তার নাম হেমন্তকুমারী ঢোপকল নামেই পরিচিত হতে থাকে
ব্রিটিশ আমলে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন মোড়ে, পাড়া-মহল্লায় বসানো হয়েছিল ঢোপ কল। তখনকার দিনে শহরে আধুনিক নলকূপ বা পানির লাইন সবার ঘরে পৌঁছায়নি। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী, ঘোড়ারগাড়ি চালক, পথচারীরা এই ঢোপ কল থেকে পানি সংগ্রহ করত। অনেকে এটিকে গোসলের জন্য, আবার অনেকে পারিবারিক নানা কাজে ব্যবহার করত।
ঢোপ কলের পাশে ছোট ছোট পাকা চাতাল বা মাচাও থাকত, যেখানে মানুষ বসে বিশ্রাম নিত, গল্প করত। অনেক সময় ঢোপ কল হয়ে উঠত পাড়া-মহল্লার এক সামাজিক মিলনস্থল।
ঢোপ কল কেবল পানি সংগ্রহের কেন্দ্রই ছিল না, এটি ছিল এক সামাজিক সংযোগস্থল। এখানে শিশুরা খেলা করত, বৃদ্ধরা বিশ্রাম নিত, আর মহিলারা একসাথে পানি তুলতে এসে পারিবারিক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গল্প করত। অনেক বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, এমনকি বিবাদও জন্ম নিত এই ঢোপ কলের আশেপাশে।
১৯৮০ ও ৯০ দশকে শহরের পানি সরবরাহব্যবস্থার আধুনিকায়নের ফলে ঢোপ কল ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। অনেক কল অকেজো হয়ে পড়ে, অনেক জায়গায় সেগুলো তুলে ফেলা হয়। নবীন প্রজন্মের কাছে ‘ঢোপ কল’ শব্দটাই এখন অচেনা, অজানা।
যদিও ঢোপ কল এখন আর ব্যবহৃত হয় না, তবুও এটি রাজশাহীর লোকজ ইতিহাস ও নগর সংস্কৃতির এক মূল্যবান অংশ। রাজশাহীর ঢোপ কল যেন এক হারিয়ে যাওয়া সুর, যেটি এখনো প্রবীণদের মনে বাজে। এটি কেবল একটি পানির কল নয়, ছিল একটি জীবনযাপন, একটি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী
গোদাগাড়ী, রাজশাহী।