November 21, 2024, 6:21 am
উজ্জ্বল রায়।।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার বিরাট একটা অংশ জুড়ে ছিল পরিবেশ-সচেতনতা।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষভাবে জমিদারি দেখাশোনা ছেড়ে দিলে, তাঁর প্রতিভূ নিযুক্ত হন জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ। মহালে গিয়ে তিনি গ্রামের দূরবস্থা দেখেই পিতাকে তার করেন ‘সেন্ড ফিফটি থাউজেন্ড’ এবং উত্তর পান ‘কাম ব্যাক্’। অতঃপর তাঁর বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ প্রমুখের ব্যর্থতার পরে ১৮৯০ সালে ব্যবস্থাপক হন রবীন্দ্রনাথ। তিনি অবশ্য গোড়ায় পান কেবল জমিদারি পরিদর্শনের ভার। সফল শিক্ষানবিশির পরে রবীন্দ্রনাথ ‘পাওয়ার অফ এটর্নি’র মাধ্যমে পিতার কাছ থেকে সমগ্র সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের সর্বময় কর্তৃত্ব পান ১৮৯৬ সালের ৮ই আগস্ট।
লক্ষণীয় ব্যাপারটি হল জমিদারির ম্যানেজারিতেও কবি পূর্বসূরিদের হাঁটা-রাস্তা ছেড়ে এগোলেন প্রথা ভাঙার কঠিন রাস্তায়, তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের অতিরিক্ত বেশ কিছু করণীয় কর্মের সাধনকল্পে; সোজাকথায় গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লীমঙ্গল সাধনের মানসে। ‘ফিরে চল্ মাটির টানে’-কথাটা শুধু গান ছিল না, ছিল রবীন্দ্রনাথের অন্তরের কথা। তিনি জানতেন ‘বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমার স্বদেশ হইয়া উঠিবে, তাহা নহে।’ তিনি বুঝেছিলেন, গ্রামই ভারতের প্রাণ; গ্রামের উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই নিজের জমিদারিতে পল্লী উন্নয়নের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন : ‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দু’টি ছোট গ্রাম। এদের মনকে পেতে হবে, এদের সঙ্গে একত্র কাজ করবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সেটা সহজ নয়, খুব কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন। আমি যদি কেবল দু’টি তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরি হবে।’
তিনি নিজে ধনকামী জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও বলতে পেরেছিলেন : ‘ধনের ধর্ম অসাম্য। ধনকামী নিজের গরজে দারিদ্র্য সৃষ্টি করিয়া থাকে।’ জমিদারি ব্যবসা সম্পর্কে তাঁর যত বিতৃষ্ণাই থাকুক, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু দেশকে চিনেছিলেন এই জমিদারি পরিচালনা করতে এসেই। তাঁর জীবনে নতুন মোড় ফিরেছিল ১৮৯১ সালে। তখনই তাঁর মাটি সংলগ্ন জীবনটির গোড়াপত্তন।
১৯০৬ সালে কৃষিবিদ্যা ও গোষ্ঠবিদ্যা শেখাতে তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে পাঠালেন আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা কন্যা মীরার বিবাহের পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীও বিদেশে প্রেরিত হন কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য। যে-যুগে সন্তানদের আই. সি. এস বা ব্যারিস্টার বানানো ধনী বাঙালি পরিবারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, সে-সময় জনৈক ধনী জমিদারের পুত্র, জামাতা ও বন্ধুপুত্রকে চাষাবাদ শিখতে বিদেশ পাঠানোর মতো একটা বিপ্লবাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একমাত্র রবীন্দ্রনাথের মতো একজন দায়বদ্ধ স্বদেশভাবুকের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।
ব্যতিক্রমধর্মী এই উদ্যোগটির পেছনে কাজ করেছে গ্রামবাংলার জনসাধারণের উন্নতিবিধান এবং বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ ও ফসল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদ। ১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথরা বিদেশ থেকে ফিরে কবির তত্ত্বাবধানে শুরু করেন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, সার, বীজ, সেচ ইত্যাদির ব্যবহারসংবলিত। আজ যে-পন্থায় সারা উপমহাদেশে চাষবাস করা হয় সে-প্রক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন শতবর্ষ পূর্বে। কোনোরকম ডামাডোল ব্যতিরেকে সত্যকার নীরব বিপ্লব ছিল ওটা আজকের মতো চ্যানেল-চীৎকৃত ‘নীরব বিপ্লব’ নয়। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন ৮০ বিঘা খাস জমিতে চালু হয় সুদূর ভবিষ্যৎমুখী সেই আধুনিক কৃষি খামার, যার আদলে পুরো গ্রামেই গড়ে উঠবে এর রক্ষাকবচ সমবায়ী খামার।
১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা, শান্তিনিকেতনে। পরের বছর পাশেই এর পরিপূরক প্রতিষ্ঠান শ্রীনিকেতনের সৃষ্টি। পল্লী-সংগঠনের অনেক পরিকল্পনা পতিসর থেকে স্থানান্তরিত হল শ্রীনিকেতনে। এল্মহার্স্ট সাহেব ও কালীমোহন ঘোষ নিলেন তার ভার। লক্ষণীয় যে, ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ শেষবার যান শিলাইদহে। সে বছরই বোলপুরে শুরু হয় শ্রীনিকেতনের নতুন কর্মযজ্ঞ। জমিদারি পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে পল্লী সংগঠনের আদিপর্বে বাংলাদেশের মরা গাঙে আদি জোয়ারটি এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথই।
১৮৯১ সালে জমিদারির শিক্ষানবিশি করতে এসেই রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-চাঁড়ালের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে তাঁর কর্মক্ষেত্রে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন নতুন সংঘাতের অমোঘত্বের কথা জেনেও। সংঘাতের মোকাবিলায় কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রথমেই তিনি তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করলেন, ‘সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে।’ এই সাহা-শেখ কোনো সাম্প্রদায়িক অর্থে নয় : যথাক্রমে ‘আমলা’ আর ‘চাষা’ অর্থে। এই কর্মসূচির বাস্তবায়নে বহু ‘আমলা’র চাকরিও গিয়েছে। জমিদারি এস্টেটকে রবীন্দ্রনাথ কী রকম ওয়েলফেয়ার এস্টেটে পরিণত করেছিলেন রাজশাহী জেলাগেজেটীয়ার-সম্পাদক এল. এস. এস. ও-ম্যালে, আই. সি. এস ১৯১৬ সালে তার এক পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়েছেন :
‘It must not be imagined that a powerful landord is always oppressive and uncharitable. A striking instance to the contrary is given in the Settlement Officer’s account of the estate of Rabindranath Tagore, the Bengali poet, whose fame is world-wide. It is clear that to poetical genius he adds practical and beneficial ideas of estate management, which should be an example to the local Zamindars.
A very favourable example of estate government is shown in the property of the poet, Sir Rabindranath Tagore. The proprietors brook no rivals. Sub-infeudation within the estate is forbidden, raiyats are not allowed to sublet on pain of ejectment. There are three divisions of the estate, each under a Sub-manager with a staff of tahsildars, whose accounts are strictly supervised. Half of the Dakhilas are checked by an officer of the head office.
Employees are expected to deal fairly with the raiyats and unpopularity earns dismissal. Registration of transfer is granted on a fixed fee, but is refused in the case of an undesirable transferee. Remissions of rent are granted when inability to pay is proved. In 1312 (BS) it is said that the amount remitted was Rs. 56,595. There are Lower Primary Schools in each division and at Patisar, the centre of management, there is a High English School with 250 students and a Charitable dispensary.
These are maintained out of a fund to which the estate contributes annually Rs. 1250 and the raiyats 6 pies to rupee in their rent. There is an annual grant of Rs. 240 for the relief of cripples and blind. An agricultural bank advances loans to raiyats at 12 per cent per annum. The depositors are chiefly Calcutta friends of the poet, who get interest at 7 per cent. The bank has about Rs. 90,000 invested in loans.’
জনৈক ঔপনিবেশিক ইংরেজ প্রশাসকের এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রমাণ করে কেমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গিয়েছে এদেশের পল্লীতে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে, আমাদের বহু পুরুষ পূর্বে। যে-জনপ্রিয়তা চাকরিরক্ষার মাপকাঠি হিসেবে বিশশতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের ‘জমিদারিতে প্রতিষ্ঠিত’ হয়েছিল বাংলাদেশেরই এক প্রান্তিক অঞ্চলে, সে-জনমুখী মাপকাঠি তো একুশশতকের শুরুতেও বাংলাদেশের ‘সরকারিতে প্রচলিত’ হবার কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। জমিদারির বদলে আসমানদারি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ এই রূপান্তরণ-কর্মটিকেই।
জমিদারির কার্যক্ষেত্র গ্রাম। সর্বার্থে শহুরে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব পেয়ে সেখানে গিয়ে প্রথমেই গ্রামকে যথাযথভাবে চিনে নেন একজন নিরাবেগ সমাজবিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণে। সেই চেনা সার্বিকভাবেই মৌলিক এবং বিস্ময়কররকম সামগ্রিক। ১৯০৭ সালের পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীতে সভাপতির ভাষণ থেকে তাঁর কিছু উক্তির উদ্ধৃতিই উপলব্ধ সমস্যার স্বরূপ অনুধাবনে যথেষ্ট হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
‘গ্রামের মধ্যে চেষ্টার কোনো লক্ষণ নেই। জলাশয় পূর্বে ছিল, আজ তাহা বুজিয়া আসিতেছে; কেননা দেশের স্বাভাবিক কাজ বন্ধ। যে গো-চারণের মাঠ ছিল তাহা রক্ষণের কোনো উপায় নাই, যে দেবালয় ছিল তাহা সংস্কারের কোনো শক্তি নাই; যে-সকল পণ্ডিত সমাজের বন্ধন ছিলেন তাঁহাদের গো-মুর্খ ছেলেরা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যবসা ধরিয়াছে। …জঙ্গল বাড়িয়া উঠিতেছে, ম্যালেরিয়া নিদারুণ হইতেছে, দুর্ভিক্ষ ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে; অকাল পড়িলে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত ক্ষুধা মিটাইয়া বাঁচিবে এমন সঞ্চয় নাই। …অন্ন নাই, স্বাস্থ্য নাই, আনন্দ নাই, ভরসা নাই, পরস্পরের সহযোগিতা নাই, আঘাত উপস্থিত হইলে মাথা পাতিয়া লই, মৃত্যু উপস্থিত হইলে নিশ্চেষ্ট হইয়া মরি, অবিচার উপস্থিত হইলে অদৃষ্টকে দোষী করি এবং আত্মীয়ের বিপদ উপস্থিত হইলে দৈবের উপর তাহার ভার সমর্পণ করিয়া বসিয়া থাকি।’
‘সমাজ ভেদ’ প্রবন্ধে তিনি বলেন : ‘দেশের অন্নে টোলের আর পেট ভরিতেছে না; দুর্ভিক্ষের দায়ে একে একে তাহারা সরকারি অন্নসত্রের শরণাপন্ন হইতেছে; দেশের ধনী মানীরা জন্মস্থানের বাতি নিবাইয়া দিয়া কলিকাতায় মোটর গাড়ি চড়িয়া ফিরিতেছে। তাই দেশের জমিদারদিগকে বলিতেছি, হতভাগ্য রায়তদিগকে পরের হাত ও নিজের হাত হইতে রক্ষা করিবার উপযুক্ত শিক্ষিত সুস্থ ও শক্তিশালী করিয়া না তুলিলে কোনো ভাল আইন বা অনুকূল রাজশক্তির দ্বারা ইহারা কদাচ রক্ষা পাইতে পারিবে না। ইহাদিগকে দেখিবামাত্র সকলেরই জিহ্বা লালায়িত হইবে। এমনি করিয়া দেশের অধিকাংশ লোককেই যদি জমিদার মহাজন পুলিস কানুনগো আদালতের আমলা, যে ইচ্ছা সে অনায়াসেই মারিয়া যায় ও মারিতে পারে, তবে দেশের লোককে মানুষ হইতে না শিখাইয়াই রাজা হইতে শিখাইব কেমন করিয়া?’
‘আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তাতে বলতে পারি, আমাদের দেশের মূঢ় রায়তদের জমি অবাধে হস্তান্তর করবার অধিকার দেওয়া আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া। এক সময় সেই অধিকার তাদের দিতেই হবে, কিন্তু এখন দিলে কি সেই অধিকারের কিছু বাকি থাকবে? জমি যদি খোলা বাজারে বিক্রি হয়ই তা হলে যে ব্যক্তি চাষ করে, তার কেনবার সম্ভাবনা অল্পই; যে লোক চাষ করে না কিন্তু যার আছে টাকা, অধিকাংশ বিক্রয়যোগ্য জমি তার হাতে পড়বেই। জমি বিক্রয়ের সংখ্যা কালে কালে ক্রমে যে বেড়ে যাবে, এ কথাও সত্য। কারণ, উত্তরাধিকারসূত্রে জমি যতই খণ্ড-খণ্ড হতে থাকবে, চাষীর সাংসারিক অভাবের পক্ষে সে জমি ততই অল্পস্বত্ব হবেই; কাজেই অভাবের তাড়ায় খরিদ বিক্রি বেড়ে চলবে। এমনি করে ছোট ছোট জমিগুলো স্থানীয় মহাজনের বড়ো বড়ো জালের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে।’
‘মস্ত একটা ফাঁকির মধ্যে আছি। এমন জমিদারি ছেড়ে দিলেই তো হয়? কিন্তু কাকে ছেড়ে দেবো? অন্য এক জমিদারকে? গোলাম-চোর খেলার গোলাম যাকেই গতিয়ে দিই, তার দ্বারা গোলাম-চোরকে ঠেকানো হয় না। প্রজাকে ছেড়ে দেবো? তখন দেখতে দেখতে এক বড়ো জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে। রক্ত পিপাসায় বড় জোঁকের চেয়ে ছিনে জোঁকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারি নে।’
রাশিয়ার চিঠিতে তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন জমিদারি পরিচালনার সময় তাঁর অভিপ্রায় কী ছিল :
‘চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে, জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর। দ্বিতীয়ত, সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আল-বাঁধা টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসীতে জল আনা একই কথা।’
‘আমরা ভদ্রলোক, সেই ভদ্রলোকদের সমস্ত দাবি আমরা নীচের লোকদের কাছ থেকে আদায় করব, এ কথা আমরা ভুলতে পারি নে। আমরা তাদের হিত করতে এসেছি, এটাকে পরম সৌভাগ্য জ্ঞান করে এক মুহূর্তে আমাদের পদানত হবে, আমরা যা বলব তাই মাথায় করে নেবে, এ আমরা প্রত্যাশা করি। কিন্তু ঘটে উল্টো। গ্রামের চাষীরা ভদ্রলোকদের বিশ্বাস করে না। তারা তাদের আবির্ভাবকে উৎপাত এবং তাদের মতলবকে মন্দ বলে গোড়াতেই ধরে নেয়। দোষ দেওয়া যায় না, কারণ, যারা উপরে থাকে তারা অকারণে উপকার করবার জন্যে নীচে নেমে আসে এমন ঘটনা তারা সর্বদা দেখে না উল্টোটাই দেখতে পায়। তাই যাদের বুদ্ধি কম তারা বুদ্ধিমানকে ভয় করে। গোড়াকার এই অবিশ্বাসকে এই বাধাকে নম্রভাবে স্বীকার করে নিয়ে যারা কাজ করতে পারে, তারাই এ-কাজের যোগ্য।’
রবীন্দ্রনাথের মতে ‘গ্রামের কাজের দুটো দিক আছে। কাজ এখানে থেকে করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও করতে হবে। এদের সেবা করতে হলে শিক্ষা লাভ করা চাই।’
মানে, এদের থেকে আগে শিক্ষা নেওয়া চাই। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে উল্লিখিত সমাজতত্ত্বের মৌল সত্যগুলিকে রবীন্দ্রনাথ ভাষায় প্রকাশ করার পরে বাস্তবেও প্রমাণ করেছেন বিশশতকের শুরুতে। সেসব এড়িয়ে গিয়ে আমরা কেবল তাঁর কাব্য পড়েছি আর গান গেয়েছি। প্রতিপক্ষে একই বাণী পঞ্চাশ বছর পর মাও সে তুং প্রচার করামাত্রই তাঁর কাছ থেকে আমরা তা কোরানের বাণীর মতো শ্রদ্ধাভরেই গ্রহণ করেছি।
পল্লী সংগঠনের প্রথম পর্যায়েই রবীন্দ্রনাথ চালু করেন হিতৈষীবৃত্তি ও কল্যাণবৃত্তি। সেই বাবত সংগৃহীত সব টাকাই ব্যয় হতো জমি ও প্রজার উন্নয়নে। প্রজাদের কাছ থেকে হাল-বকেয়া খাজনার টাকা-প্রতি তিন পয়সা হিসাবে হিতৈষীবৃত্তি আদায় হত। জমিদারি সেরেস্তা থেকে মোট সংগৃহীত টাকার সমপরিমাণ দেওয়া হত, পরবর্তীকালের সরকারি ‘বেনিভোলেন্ট ফান্ড’ বা হিতৈষী তহবিলের ‘একুইটি গ্রান্ট’ বা সমহারিক দান হিসেবে। সেই টাকা খরচের ব্যবস্থা করত প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত হিতৈষী সভা।
কল্যাণবৃত্তিও টাকায় তিন পয়সা। তার জন্যে আলাদা রসিদও দেওয়া হত এবং আদায়ের সমপরিমাণ টাকা দিতেন জমিদার নিজে। এইভাবে বছরে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা সংগৃহীত হত। তাছাড়া সায়রাত-মহাল বন্দোবস্ত হলে মোট নজরের শতকরা আড়াই টাকা ও নামখারিজের নজরানা সরকারি আইনে শতকরা পাঁচ টাকা আদায় হত। এই টাকাই ব্যয় হয়েছে রাস্তাঘাট নির্মাণে, মন্দির-মসজিদ সংস্কারে, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপনে আর চাষীদের বিপদ-আপদের সাহায্যে।
শিলাইদহে স্থাপিত হয় মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়। পতিসরে বসানো হয় বড় হাসপাতাল এবং কালীগ্রাম পরগণার তিনটি বিভাগে নিয়োজিত হন তিন জন ডাক্তার। ‘হেলথ্ কোঅপারেটিভ্’-এর মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা সারা ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম চালু করেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর নিজ জমিদারিতে।
এই প্রজাহিতৈষী জমিদার কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ পর্যন্ত ছয় মাইল রাস্তা তৈরি করিয়ে দেন এই শর্তে যে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে স্থানীয় গ্রামবাসী। কুয়ো খোঁড়ার দায়িত্ব দেন গ্রামবাসীকে আর তিনি দায়িত্ব নেন এস্টেট থেকে কুয়ো বাঁধানোর। পুকুর সংস্কারও চলে একই রীতিনীতিতে। রবীন্দ্রনাথের অংশীদারি-ভিত্তিক উন্নয়নের কার্যকর এই নীতিটিকে তাঁর স্বকালে কেউ আমলে নেয়নি। কিন্তু একই জিনিস ‘পার্টিসিপেটরি ডেভেলপমেন্ট ফরমুলা’ নামে পশ্চিম থেকে নাজেল হওয়ামাত্রই তার ওপর পিএইচ. ডি অর্জনের জন্যে দলে দলে লাইনে দাঁড়িয়েছেন এদেশের মেধাবীগণও।
পতিসরে কবি একটি ধর্মগোলাও বসান, সেখানে এবং শিলাইদহে স্থাপন করেন আদর্শ কৃষিক্ষেত্র যেখানে সুদূর অতীতের সেই ১৯১০ সালেই ব্যবহৃত হয় ট্রাক্টর, পাম্পসেট আর জৈব সার এবং চাষ হয় তখনকার উচ্চফলনশীল ফসল। নৌকো বোঝাই নষ্ট ইলিশ সস্তায় কিনে তাতে চূন দিয়ে মাটিতে পুঁতে তৈরি হয় এই জৈবসার। অধিক ফলনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি ল্যাবরেটরি। কালীগ্রামে চাষ সম্পর্কে এক চিঠিতে কাব্যরসের কারবারী তাঁর জনৈক কর্মীকে লিখছেন :
‘প্রজাদের বাস্তুবাড়ি, ক্ষেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস কলা খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদের উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল, আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে।’
কুটীরশিল্পের উন্নয়নেও হাত দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বয়নশিল্প শেখাতে শ্রীরামপুরে নিয়ে যাওয়া হল একজন তাঁতীকে। স্থানীয় একজন মুসলমান জোলাকে পাঠানো হল শান্তিনিকেতনে তাঁতের কাজ শিখতে। তিনি এসে খুললেন তাঁতের স্কুল। পটারির কাজেও হাত দেওয়া হল একই সময়ে। রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লেখেন :
‘বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলচে, সেই রকম একটা কল এখানে (পতিসরে) আনতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে। …এখানকার চাষীদের কোন্ industry শেখানো যেতে পারে সেই কথা ভাবছিলুম। এখানে ধান ছাড়া আর কিছু জন্মায় না। এদের থাকবার মধ্যে কেবল শক্ত এঁটেল মাটি আছে। আমি জানতে চাই Pottery জিনিসটাকে Cottage industry-রূপে গণ্য করা চলে কিনা। একবার খবর নিয়ে দেখিস ছোটখাট furnace আনিয়ে এক গ্রামের লোক মিলে এ কাজ চালানো সম্ভবপর কিনা। আরেকটা জিনিস আছে ছাতা তৈরি করতে শেখানো। সে রকম শেখাবার লোক যদি পাওয়া যায় তাহলে শিলাইদহ অঞ্চলে এই কাজটা চালানো যেতে পারে। নগেন্দ্র (রবীন্দ্রনাথের শ্যালক) বলছিল খোলা তৈরি করতে পারে এমন কুমোর এখানে আনতে পারলে বিস্তর উপকার হয়। লোকে টিনের ছাদ দিতে চায় পেরে ওঠে না; খোলা পেলে সুবিধা হয়।’
দয়ালু জমিদার সাজার বদলে স্বাবলম্বী প্রজা বানাবার ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগী জমিদার রবীন্দ্রনাথের প্রজাসাধারণের সামাজিক অস্তিত্বের সার্বিক দিকে মনোযোগ দেবার প্রক্রিয়ায় সালিশির দিকেও নজর পড়েছিল। তিনি প্রজাদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা চালু করে দিলেন। তাঁর আমলে জমিদারির মধ্যে কোনো বিবাদ নিয়ে প্রজারা আদালতে যেত না।
প্রত্যেক গ্রামের লোকেরা তাঁদের ভিতর থেকে একজনকে প্রধান মনোনীত করতেন। ওই গ্রামপ্রধানরাই পরে আবার পরগণার সব প্রধানদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে মনোনীত করতেন। তাঁদের বলা হত পঞ্চপধান। বিবাদ ও বিরোধ পঞ্চপ্রধানরাই মিটিয়ে দিতেন। শেষ আপীল রবীন্দ্রনাথের কাছে। এই বিচারে অসন্তুষ্ট হয়ে কোনো পক্ষ আদালতে নালিশ করলে গ্রামের লোকেরা তাঁকে সমাজচ্যুত করে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত এই বিচার ব্যবস্থায় মামলার কোনো খরচ লাগত না, বিচারে বিলম্বও হত না। এই ব্যবস্থা কালীগ্রাম পরগণায় রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরেও দেশবিভাগ পর্যন্তই চালু ছিল।
তাহলে দেখা যায় যে গ্রামপঞ্চায়েত প্রথা প্রবর্তনেরও পূর্বসূরি সমাজতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতিক ফজলুল হক ও জ্যোতি বসু প্রমুখ তাঁর দূরবর্তী ও সুদূরবর্তী উত্তরসূরিমাত্র।
সমবায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহও তাঁর কর্ম জীবনের সেই আদি যুগের। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, গ্রামকে বাঁচাতে হলে ‘সমবায়নীতি ছাড়া আমাদের উপায় নেই।’ ঐকত্রিক চাষ সম্বন্ধেও পথিকৃতের অবদান রবীন্দ্রনাথের, যিনি পতিসরে সেই ১৯০৫ সালেই কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন সমবায়নীতি বাস্তবায়নকল্পে। তিনি দেখলেন, মহাজনদের কাছ থেকে চাষীদের মুক্ত করতে না পারলে দেশের দুর্গতি দূর হবে না। কৃষি বা কুটিরশিল্পের জন্য যে মূলধন দরকার তা তারা কোনদিনই সংগ্রহ করতে পারবে না।
চাষীদের অল্প সুদে ঋণ দিতে তাই খোলা হল পতিসর কৃষি ব্যাংক, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। নোবেল প্রাইজে তিনি যে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা পান তাও ঢালা হয় এই ব্যাংকে। এই ব্যাংকের ঋণে প্রজাদের দারুণ উপকার হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তারা মহাজনের দেনা শোধ করে। কালীগ্রাম থেকে মহাজনরা ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এই ব্যাংক চলেছিল পুরো কুড়ি বছর। লক্ষণীয় যে এ-ব্যাপারেও সমাজবিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথই পথিকৃৎ, নোবেলজয়ী ডক্টর ইউনূস কবির আট দশক পরের উত্তরসূরি।
ব্যাংকের অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ চালু করেন অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ এক ব্যবসা, ১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় স্থাপিত হয় ‘ট্যাগোর অ্যান্ড কোং’। এই ঠাকুর-কোম্পানি ন্যায্য মূল্যে চাষীদের ধান ও পাট কিনে বাজারে বিপণনের দায়িত্ব নেয়। সরাসরি বিপণনে অক্ষম প্রাথমিক উৎপাদকদের ন্যায়সঙ্গত পণ্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থাস্বরূপ এটা ছিল একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগ। এক্ষেত্রেও জমিদার রবীন্দ্রনাথই আবির্ভূত হলেন তাঁর চাষা-ভুষো প্রজাদের আয় বাড়ানোর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপকরূপে। সেটা ছিল তাঁর পল্লীমঙ্গল সাধনকল্পে এক মহতী প্রয়াস। সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলকার্যের ধারা সম্পর্কে অতুল সেনকে কবি এক পত্রে লিখেছেন :
‘কাজের সঙ্গে সঙ্গে একটি আনন্দের সুর বাজাইয়া তুলিতে হইবে। আমাদের গ্রামের জীবনযাত্রা বড়োই নিরানন্দ হইয়া পড়িয়াছে। প্রাণের শুষ্কতা দূর করা চাই। হিতানুষ্ঠানগুলিকে যথাসম্ভব উৎসবে পরিণত করিবার চেষ্টা করিয়ো। বৎসরে একদিন বৃক্ষরোপণ উৎসব করিবে। বৈশাখের শেষে কোনো একদিন ইস্কুলের ছুটি দিয়া সব ছেলেদের বনভোজন ও বৃক্ষরোপণ করিবার আয়োজন করিলে ভাল হয়। রাস্তা প্রভৃতির কাজ আরম্ভ করিবার প্রথম দিনটায় একটু উৎসবের ভাব থাকিলে এগুলো ধর্মকর্মের চেহারা পাইবে।
আরেকটি কথা মনে রাখা চাই। চাষী গৃহস্থদের মনে ফুলগাছের সখ প্রবর্তন করিতে পারিলে উপকার হইবে। প্রত্যেক কুটিরের আঙিনায় দুই-চারিটি বেলফুল, গোলাপ ফুলের গাছ লাগাইতে পারিলে গ্রামগুলি সুন্দর হইয়া উঠিবে। দেশে এই সৌন্দর্যের চর্চা অত্যাবশ্যক একথা ভুলিলে চলিবে না’।
তাই তো। কবিত্ব-যে এই সমাজবিজ্ঞানীর ব্যক্তিত্ব থেকে অবিচ্ছেদ্য।
পরিবেশ ভাবনা
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার বিরাট একটা অংশ জুড়ে ছিল পরিবেশ-সচেতনতা। দূষণমুক্ত পরিবেশ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন তাঁর কাল থেকে বিস্ময়কর রকম অগ্রগামী। বিশ্বমানবতার এই মহান কবি যদিও পরিবেশ বলতে বিশ্বমানবের পরিবেশই বুঝতেন, তবু তাঁর স্বদেশই ছিল এর কেন্দ্রে। তাঁর বাংলাদেশ ছিল, নগরবাংলা নয়, গ্রামবাংলা, সবুজ পত্রপল্লবে ঢাকা পাখিডাকা নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবস বাইশে শ্রাবণকে তাঁর আশ্রম শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণদিবস হিসেবে ধার্য করা হয়েছে।
বৃক্ষরোপণের দিন নবজীবন উদ্বোধনের দিন। রবীন্দ্রনাথের যাপিত জীবনের এই দিনটির সঙ্গে নবজীবন সৃজনের এই অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি যোজিত হয়ে চলে আসছে তাঁর ১৯৪২ সালের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী থেকে ২০১০ সালের ২২ শ্রাবণ পর্যন্ত বিগত ৬৯টি বৎসর যাবৎ। রবীন্দ্রপ্রয়াণ-দিবসটির স্মরণে কে, কোন জায়গায়, কী বৃক্ষরোপণ করেছেন তার পঞ্চাশ বছরের একটা তালিকা পাওয়া যাবে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘স্মরণ : বাইশে শ্রাবণ’ গ্রন্থে।
প্রসঙ্গক্রমে, বাইশে শ্রাবণে শান্তিনকেতনে বৃক্ষরোপণকারী কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করছি। মীরা দেবী, আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী, প্রতিমা দেবী, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, সুরেন্দ্রনাথ কর, অধ্যাপক তান য়ুন সান, প্রবোধচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী, অনিলকুমার চন্দ, রামকিংকর বেজ, ভারতের রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি, মন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী, কাজুও আজুমা, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শান্তিদেব ঘোষ, শঙ্খ ঘোষ, শ্রীমতী অমলাশঙ্কর প্রমুখ। এভাবে বর্ষার ঋতু-উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় কবির জীবনের অন্তিমদিবস উপলক্ষে নবজীবনের উদ্বোধকস্বরূপ বৃক্ষরোপণ।
তবে কবির মৃত্যুদিনকে তাঁর আশ্রমে বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে চিহ্নিতকরণের ভিত্তিটি শুধুই নবজীবনের উদ্বোধন নয়, আরো গভীর এবং ব্যাপক। সেটি অনুধাবন করতে হলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৃক্ষের সম্পর্কটা সম্যক জানতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি প্রথম জন্মেছিলেন বৃক্ষ হয়েই। ছিন্নপত্রের ৬৪ তথা ছিন্নপত্রাবলীর ৭০-সংখ্যক পত্রটি কবির আত্মপরিচয় উন্মোচনের পরম্পরায় পাঠককে যেন প্রকৃতি থেকে মনুষ্যের বিবর্তনের একেবারে আঁতুড়ঘরেই নিয়ে যায়। ছিন্নপত্রের ৬৭ তথা ছিন্নপত্রাবলির ৭৪-সংখ্যক পত্রটি যেন প্যান্থিজমের ডেক্লারেশন, অর্থাৎ সর্বেশ্বরবাদের নির্বচন। বৃক্ষময় পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে একেবারে একাকার হয়ে আছেন কবি।
রবীন্দ্রনাথ ‘এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেন’ এবং ‘তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে’ জন্মেছিলেন বলেই তাঁর মৃত্যুদিনটিকে বৃক্ষরোপণের দিন অর্থাৎ নব নব জীবন উদ্বোধনের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। ১৯২৫ সালের পঁচিশে বৈশাখ কবির জন্মোৎসব পালিত হয় শান্তিনিকেতনে।
উত্তরায়ণের উত্তর দিকে ‘পঞ্চবটী’ (অর্থাৎ অশত্থ, বিল্ব, বট, আমলকী ও অশোক) প্রতিষ্ঠা করা হয় জন্মোৎসবের অঙ্গ হিসেবে উত্তরায়ণের উত্তর-পশ্চিম সীমানায়। বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে সেদিন কবির সদ্য রচিত গান ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও’ গীত হয়।
শান্তিনিকেতনে আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণ শুরু হয় আরো তিন বছর পরে ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই। তার দশদিন পর প্রতিমা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে কবি জানালেন, ‘এখানে ও শ্রীনিকেতনে যে দুটো উৎসব হয়ে গেছে তার সমস্ত বিবরণ তোমরা পেয়েছ। এখানে হোলো বৃক্ষরোপণ, শ্রীনিকেতনে হোলো হলচালন। শাস্ত্রীমশায় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, আমি একে একে ছটা কবিতা পড়লুম।’ যে ছটা কবিতা কবি পাঠ করেছিলেন, সেগুলি পঞ্চভূতের উদ্দেশ্যে রচিত, ক্ষিতি কিংবা পৃথিবী, অপ্ অথবা জল, তেজ কিংবা আলোক, মরুৎ অথবা বায়ু, ও ব্যোম কিংবা আকাশ। ষষ্ঠ কবিতাটি মাঙ্গলিক।
নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ করের তত্ত্বাবধানে সুসজ্জিত হন পঞ্চভূত। এঁরা ছিলেন : ক্ষিতি- সত্যেন্দ্রনাথ বিশি, অপ-সুধীর খাস্তগীর, তেজ-প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মরুৎ- মনোমোহন ঘোষ, ব্যোম- অনাথনাথ বসু। বৃক্ষ বহন করে এনেছিলেন আরিয়াম ও বিনায়ক মাসোজি। বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান হয়েছিল গৌড়প্রাঙ্গণে। এই উপলক্ষে কবি তাঁর সদ্যরচিত ‘বলাই’ গল্পটি পাঠ করেছিলেন।
এর আগেও কবি বৃক্ষরোপণ করেছেন বেশ কয়েকবার, তবে বিদেশের মাটিতে। ১৯২৬ সালে চিকিৎসকদের পরামর্শে হাঙ্গেরির বালাতন হ্রদের তীরে এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি ‘Lindentree’র চারা রোপণ করেন ৮ নভেম্বরে। সেই বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে কবি লেখেন :
হে তরু, এ ধরাতলে রহিব না যবে
সেদিন বসন্তে নব পল্লবে পল্লবে
তোমার মর্মরধ্বনি পথিকেরে কবে
‘ভালোবেসেছিল কবি বেঁচেছিল যবে’
(রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, তৃতীয় খণ্ড)
কেন এই বৃক্ষরোপণ উৎসব সে বিষয়ে কবি তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ১৯৩৯ সালে। তিনি বলেন :
‘পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির উর্বরতার ভাণ্ডার নিঃস্ব হল। এই কথা মনে রেখে কিছুদিন পূর্বে আমরা যে অনুষ্ঠান করেছিলুম সে হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, অপব্যয়ী সন্তান কর্তৃক মাতৃভাষার পূরণ করবার কল্যাণ-উৎসব’।
১৯২৮ সালের বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটির মন্ত্রপাঠে এ কথাই বলা হল যে বৃক্ষদের জন্ম শ্রেষ্ঠ। সকল জীব এদের অবলম্বন করে জীবিত থাকে। যাচকেরা এর নিকট থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে যায় না। পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া, ফুল, বল্কল, কাষ্ঠ, গন্ধ, রস, ক্ষার, সার, অঙ্কুর – এই সকলের দ্বারা এরা লোকের কাম্যবস্তু দান করে। সংসারে সকল সম্পদের হেতু, ভূমিলক্ষ্মীর কেতুস্বরূপ ও জীবগণের জীবনৌষধাস্বরূপ এই তরুগণ অক্ষত হয়ে বেঁচে থাকুক।
১৩৪৩ সালে অনুষ্ঠানে নতুনত্ব এল। উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভুবনডাঙা গ্রামে। বিশ্বভারতীর উদ্যোগে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় জলাশয় পরিষ্কার করে তার তীরেই উৎসব মণ্ডপ রচিত হয়েছিল। কবি রোপণ করেছিলেন কৃষ্ণচূড়া। ১৩৪৪ সালে শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল গ্রামে বিশ্বভারতীর ‘হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ’ উৎসব সম্পন্ন হয়েছিল। অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁকে সাহায্য করেন ক্ষিতিমোহন সেন। কবি আসন গ্রহণ করলে সাঁওতালরা তাঁকে হাতে বোনা কাপড় উপহার দেয়। পরে ক্রমান্বয়ে হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
এর পরের বছর বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব শ্রীনিকেতনে অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে কবি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘মানুষ গৃধ্নুভাবে প্রকৃতির দানকে গ্রহণ করেছে, প্রকৃতির সহজ দানে কুলোয় নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে। …এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে, দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া।
তাহলে দেখা যায় যে আজকের পরিবেশ আন্দোলনের পথিকৃতের ভূমিকাও রবীন্দ্রনাথেরই, যা তিনি শান্তিনিকেতনে শুরু করেন ১৯২৫ সালে পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং জোরদার করেন ১৯২৮ সালে বর্ষাঋতু-উৎসব উদযাপনের চল করার মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান-লেখিকা র্যাচেল কারসন-এর একটি পুস্তকের সূত্রে সেখানে আকস্মিকভাবে পরিবেশচর্চার সূচনা ও প্রসার ঘটে বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ-উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করার চার দশক পরে।
বিদেশে পরিবেশ চেতনা ও চর্চার কিছু তথ্য এখানে আমি উল্লেখ করছি শুধু এ সত্যটুকুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যে, বিষয়টির মর্মবস্তু রবীন্দ্রনাথ কত আগে এবং কত গভীরভাবে বলে গেছেন এবং কর্মে পরিণত করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত সেই বৃক্ষরোপণ প্রথার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাশ্রম শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন এলাকার অনুসরণে বৃক্ষরোপণ-উৎসব যেন দেশময় প্রচলিত হয় এবং তাঁর প্রিয় স্বদেশের পরিবেশ যেন কখনো কলুষিত না হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞশেষে ব্যাপক পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডের সূত্রেই বিশ্বময় পরিবেশ দূষণের বিপর্যয় নেমে আসে। ষাটের দশকে অতি দ্রুত উচ্চফলনশীল কৃষি উৎপাদনেরর আকাক্সক্ষায় আমেরিকায় আবিষ্কৃত যুগান্তকারী কীটনাশক রাসায়নিক ডিডিটি-র বিশ্বব্যাপী যথেচ্ছ ব্যবহারই প্রধানত উপকারী-অপকারী নির্বিশেষে কীটপতঙ্গ-জীবাণুর প্রাণবৈচিত্র্য নিধন ও বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে পৃথিবীর স্থাবর-জঙ্গম সকল প্রাণীর জীবনকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয় এবং ডেকে আনে প্রকৃতির প্রতিশোধের পাল্টা হুমকিও। অথচ এত বড় পরিবেশ-সংকটটি মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।
বিজ্ঞানী-সাহিত্যিকা র্যাচেল কারসন প্রণীত এবং ১৯৬২ সালে প্রকাশিত সাহিত্য-শ্রেণির বই ‘দি সাইলেন্ট স্প্রিং’ প্রথমে আমেরিকায়, তারপর দিকে দিকে সাড়া ফেলে দেয়। পুস্তকটি এই নৈতিক সত্যটির প্রতি প্রথম অন্যমনস্ক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো যে সৃজন-ছন্দ ও বিমল আনন্দের বসন্ত নিরানন্দ ও নীরব হয়ে গেছে মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায়। পৃথিবীর বাস্তুভূমিতে প্রাণী-অপ্রাণী সকলের সমান অধিকার। বইটি বললো : বনে বনে মত্ত হাওয়ার ছন্দে, নানা ফুলের নানা গন্ধে, পাখিদের কলরবে এককথায় বসন্তসংগীতে যেন আবার সরব হয়ে ওঠে ‘নীরব বসন্ত’।
মানুষের পরিবেশ দূষণমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বইটির ঐতিহাসিক প্রতিবাদসৃষ্ট আন্দোলনের ফলস্বরূপই বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭০ সালে ‘আর্থ ডে’, ১৯৭২ সালে স্টকহোমে মানব-পরিবেশ শীর্ষক কনফারেন্স, ১৯৮০-র দশকে লন্ডন, বাজেল ও ভিয়েনায় কনভেনশন, ১৯৯২ সালে রিয়ো-তে বসুন্ধরা সম্মেলন, কিয়োটোতে পরিবেশ মহাসম্মেলন। তারই জের হিসেবে বিভিন্ন দেশের দি ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাক্ট, দি ওয়াটার অ্যাক্ট, দি এয়ার অ্যাক্ট, দি ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট ইত্যাদি পদক্ষেপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অবিলম্ব প্রয়োজন সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বকেই সচেতন করতে চেয়েছে।
অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিবেশ-সংকটকে এমনি প্রকট করে তুলবার বহুপূর্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে প্রাণের প্রাচুর্য এবং প্রকৃতির মাধুর্য নিয়ে আমাদের পৃথিবীটি যেন একটি বড়ো সমাজ যার পরিবেশকে সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে হবে। প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই ভূমিশ্রীকে মর্যাদা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এই জগতের বাস্তুব্যবস্থার একটা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা আছে, সীমা আছে। দূষণভার সহনক্ষমতার প্রায় শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে আমাদের এই ধরাধাম। পৃথিবীর মাটির নিচের ‘ফসিল-ফুয়েল’ সীমাবদ্ধ। তাই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তার মাটির উপরের ‘রিনিউয়েবল ফুয়েল’ তথা পুনরুৎপাদনশীল জলজ ও স্থলজ, স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণসম্পদের ওপর।
পুনরুৎপাদনধর্মী ইন্ধন হিসেবে বৃক্ষ মানুষের অশেষ শক্তির জোগানদার এবং অফুরান অক্সিজেন-চেম্বার হিসেবে মানুষের স্বাস্থ্যের অতন্দ্র প্রহরী। তাই বৃক্ষরোপণ-উৎসব ও বর্ষাঋতু-উৎসবের ধারাটি রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তন করেছিলেন দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতিজনিত ক্ষতিপূরণের সংস্থানস্বরূপ।
প্রতীচ্যের পরিবেশ সচেতনতার এত আগে প্রাচ্যের মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দূষণমুক্ত পরিবেশ সংরক্ষণের চিন্তা ও কার্যকর ব্যবস্থা তাঁর নিরন্তর স্বদেশভাবনারই মহত্তম প্রকাশ যা আদর্শ হতে পারে সকল মানুষের স্বদেশভাবনার।