খলিলুর রহমান খলিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
রংপুরের তারাগঞ্জে পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চাষাবাদে মাটির গুনগত মান নষ্ট হচ্ছে জেনেও চাষিরা ঝুঁকে পড়েছে বিষাক্ত তামাক চাষে। রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয়। এতে কমেছে গম, ভুট্ট, সরিষা, সবজি, ডাল, তৈলবীজ ও ধানসহ রবি মৌসুমের বিভিন্ন ফসল চাষ। তামাক চাষের ফলে ধান ফলনে বিঘা প্রতি ৫/৬ মণ কম হয় বলেও কৃষক সূত্রে জানা গেছে। তামাক চাষে কৃষক আগ্রহী হওয়ার অন্যতম কারন হলো- রংপুর অঞ্চলে তামাক চাষীদের ঋণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিকল্প ফসল উৎপাদনে বীজ প্রাপ্তিতে রয়েছে জটিলতা, উৎপাদন খরচ বেশি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য ও সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় তামাক চাষের প্রতি চাষিদের রয়েছে দুর্বলতা।
তারাগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ তামাক চাষাবাদ এলাকায় তামাক কাটা ও শুকানোর কাজে শিশুদের ব্যবহার করা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে স্কুলগামী সড়কের দু’ধারে তামাক শুকানোয় কোমলমতি শিশুশিক্ষার্থীসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে অধুমপায়ী সাধারণ জনতার। এমনও তথ্য উঠে এসছে, শিশু ও বৃদ্ধাও তামাক প্রক্রিয়াকরনে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। ক্যান্সার, হাঁপানী, স্নায়ু রোগ সহ মাদকের আগ্রসনে যুব সমাজ ও আমাদের সবুজ শ্যামল পরিবেশ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার যুক্তিঃ
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কৃষক এবং চাষিদের সাথে যখন কৃষি বিষয়ক মাঠ সমাবেশগুলো করি তখন কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহী করে থাকি। তবে তামাক চাষাববাদে কৃষক ও চাষিগণ অধিক লাভ ও চাষাবাদ তামাকজাতদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্রীম চাষাবাদ খরচ, বীজ, সার ও উৎপাদিত তামাক বিক্রয় নিশ্চয়তা পায়। বেশি লাভ ও বিক্রয় নিশ্চয়তা থাকলে চাষিরা তামাকই তো চাষ করবে, অন্য ফসলে তো তেমন লাভ নেই।
কৃষি অফিস কর্তৃক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় কি-না জানতে চাইলে বলেন, নিরুৎসাহী তো করি। এ ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেন। তামাক চাষিগণ কৃষি প্রণোদনা সেবা থেকে বঞ্চিত হলে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে মর্মে কথা হলে তিনি বলেন, এটা আমার একার কাজ নয় এবং বলে উঠেন আপনারা(সাংবাদিক) শুধু আমাকে চাপে রাখার জন্য তথ্য চাইতে আসেন। আপনারা কোন দিন তামাক চাষবাদ রোধে কোন ভূমিকা রেখেছেন? সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন করে বসেন! তিনি আরো বলেন, আমি তো অনেক কৃষি বান্ধব কাজও করি, কই সেগুলো তো তুলে ধরেন না। জবাবে সাংবাদিক বলেন, আপনি তো আলমপুর ইউপি’র এক চাষিকে মাল্টা চাষ প্রকল্প দিয়েছিলেন, গাছ বড় হয়ে ফলন দিতে শুরু করলে চাষি দেখেন- সবগুলো গাছে গুটি গুটি কমলা ধরেছে। তিনি ভূক্তভোগীর এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। এছাড়াও তামাকের বিকল্প চাষ হিসেবে পেঁয়াজ, রসুন ও সরিষা চাষাবাদ বৃদ্ধিতে কৃষি অফিসের নেই তেমন কর্যকরী ভূমিকা।
তামাক চাষে জমির পরিমানঃ
তারাগঞ্জ উপজেলায় কি পরিমান তামাক চাষ হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি চটে গিয়ে বলেন, আপনারা তো শুধু আমার দোষ ধরার জন্য পরে থাকেন। কেন জানতে চাইলে তিনি তথ্য সহায়তার জন্য অন্য কর্মকর্তার কাছে সাংবাদিকদের ট্যাগ করে দিতে চান। তথ্য দাপ্তরিক নির্ভর হবে না বললে তিনি আবারও রেগে যান।
উল্লেখ্য যে, (৩১ জানুয়ারী)-২৪ইং কৃষি কর্মকর্তার সাথে হোয়াটস আপে তামাক চাষে জমির পরিমান জানতে চাইলে ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান এবং নির্ভরযোগ্য অন্য কর্মকর্তার সহযোগীতা চাইলেও তা কর্ণপাত করেননি। উক্ত তারিখে উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা বিশ্বনাথ সরকারে সাথে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি হোয়াটস আপে তথ্য দেন ২০২২ইং- ৭৬৫ হেক্টর, ২০২৩ইং- ৮০০ হেক্টর এবং ২০২৪ইং- ১৯৯৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। বিশ্বনাথ সরকারের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতেও তিনি গাফিলতি করেন এবং পরে (৬ মার্চ)-২৪ইং অফিস স্বাক্ষৎকারে তিনি ২০২২/২৩ইং- ৯০০ হেক্টর এবং ২০২৩/২৪ইং- ৯৬০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষের তথ্য দেন, যা দাপ্তরিক ভাবে একই অফিস থেকে প্রদেয় তথ্য অমিল ও বিভ্রান্তি বটে। এছাড়াও তিনি তামাক চাষে মাটির গুনগত মানের কি পরিমান ক্ষতি হয় সে বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারেননি। উপজেলরা মোট কৃষকের শতকরা কতজন কৃষক কৃষি প্রণোদনা সুবিধা ও চলতি অর্থ বছরে কি পরিমান বীজ, সার ও অন্যান্য সুবিধা এসেছে তার কোন তথ্য দেননি।
কৃষক সূত্রে জানা গেছেঃ
তারাগঞ্জ উপজেলার রহিমাপুর চাকলা কৃষক দয়াল চন্দ্র বলেন, তিনি কৃষি অফিস থেকে কৃষি প্রণোদনার কোন সুযোগ সুবিধা পান না, ফলে তিনি তামাকজাতদ্রব্য উৎপন্নকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়ে তামাক চাষ করেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অনেক তামাক চাষি কৃষি অফিসের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেখানে কৃষি অফিস কর্তৃক তামাক চাষিদের নিরুৎসাহীত করার কথা, সেখানে কৃষি প্রণোদনার সুবিধা প্রদান প্রশ্নবিদ্ধ! এ বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম আগামীতে এমন সুবিধা প্রদান না করার আশ্বাস দেন।
তামাক চাষে নিয়ন্ত্রণঃ
তারাগঞ্জের সবুজ সুফলা মাঠে ছেয়ে গেছে বিষাক্ত তামাকের চাষ, উপজেলা প্রশাসনের চোখে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে বিগত বছরের তুলনায় ব্যাপক হারে বেড়েছে নিকোটিন তামাক চাষ। তামাকজাতদ্রব্য উৎপাদনকারী কোম্পানি কর্তৃক চাষিদের বিনাপুঁজিতে তামাক চাষের সুবিধা, বেশি লাভের সাথে বাজারজাতের পূর্ণনিশ্চয়তায় তামাক চাষ করছেন চাষিরা। এতে করে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে সাধারণ চাষাবাদ। সচেতন মহলের দাবি, তামাক চাষ বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে, আগামী দিনে উত্তরের এই জনপদে মানুষ্য খাদ্য উৎপাদন বাড়বে কমবে তামাকের চাষ। যদিও ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যুগোপযোগী করে। প্রতিবারের বাজেটে তামাকজাত পণ্যে কর বাড়ানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কমেনি তামাক চাষ উল্টো বেড়েছে। অনেকের দাবি আইনী প্রয়োগ বা যুগোপোযোগী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হলে নির্মূল হবে তামাক চাষ।
তামাক চাষে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহীন সুুলতানা বলেন, তামাক চাষের ফলে মানুষ টিবি, হাঁপানী, ফুসফুসে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ ব্যাধিতে আক্রন্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তামাক রোপন, বপন ও বিক্রয় প্রক্রিয়াজাতকরন পর্যন্ত শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট যেকোন কর্মী তামাকের ক্ষতিকর নিকোটিনের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়না।
তামাক চাষ সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এই উপজেলায় তামাক চাষাবাদ বেড়েছে, আমরা উপজেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহীত করার আহ্বান করি। তবে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি প্রণোদনা ও অন্যান্য সেবা সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করে, তামাক চাষ করে না এমন চাষিদের প্রণোদনা সুবিধা বাড়িয়ে ও অন্যান্য রবি ফসল চাষে উৎসাহী করতে হবে।

Leave a Reply