সাপেকাটা ৩ হাজার রোগি সেরেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সজিমউদ্দীনের চিকিৎসায়

মোঃ বাবুল হোসেন পঞ্চগড় প্রতিনিধি:
মো. সজিম উদ্দীন, বয়স প্রায় ৮০। তিনি একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা হলেও এলাকায় পরিচিত সাপেকাটা রোগির চিকিৎসক হিসেবে। তাবিজ-কবজ আর ঝাড়ফুঁকে নয়, ভেষজ উপায়ে তৈরি ওষুধে চিকিৎসা দেন এই প্রবীণ। গত ৫৩ বছরে তিন হাজারের বেশি রোগি এ চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে দাবি তার। এই দাবির বাস্তবতা অনেকটাই মিলেছে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে।
যে কোনো বিষধর সাপ কাটার পর অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ জরুরি হয়ে যায়। অন্যথায় রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। রোগীর শরীরে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ জরুরি হলেও হাসপাতালগুলোতে এখনও এই ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। এ অবস্থায় সাপেকাটা রোগের চিকিৎসক হিসেবে সজিমউদ্দীনের ব্যাপক সুনাম এলাকা জুড়ে। পাড়া প্রতিবেশীদেরও সম্মানী ব্যক্তি তিনি। কেউ তার সঙ্গে বিরোধেও জড়াননা। কারণ, বিপদেতো ভরসা একমাত্র তিনিই।
সজিমউদ্দীনের বাড়ি পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের বদলুপাড়া এলাকায়। তিনি সেখানকার মৃত সফিজ উদ্দীনের ছেলে। পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে নয় সাপেকাটা রোগিদের চিকিৎসা পদ্ধতি শিখিছেন তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশিক্ষণে গিয়ে।
সজিম উদ্দীনের গ্রামেই মজির উদ্দীনের বাড়ি। গত দুই বছর আগে মজির উদ্দীনের স্ত্রী খতেজা বেগম শিকার হন বিষধর সাপের দংশনের। এ সময় সজিম উদ্দীনের চিকিৎসায় সেরে ওঠেন তিনি।
মজির উদ্দীন বলেন, ‘সন্ধার দিকে আমি এবং আমার স্ত্রী গরুর জন্য খড়ের পোয়াল থেকে খড় খুলছিলাম। হঠাৎ আমার স্ত্রী চিৎকার দিয়ে ওঠে। খুঁজে দেখি তার পায়ে সাপে কাটার দাগ। মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে যায় সে। শরীরও ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করে। আমরা বেঁচে ফেরার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। এ অবস্থায় দ্রুত সজিম উদ্দীনের বাড়িতে নিয়ে যাই। পরে তার ভেষজ ঔষধে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠে আমার স্ত্রী।’ ঘটনাটি শুনতে গল্পের মত মনে হলেও বাস্তব দাবি করেন তিনি।
সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের পৌটিয়াপাড়া এলাকার শরিফত আলী জানান, তার স্ত্রী বিউটি বেগমকে এক অপরিচিত সাপে দংশন করলে তাৎক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা সজিমউদ্দীনের শরনাপন্ন হন। মুহূর্তেই সুস্থ হয়ে ওঠে তিনি।
খতেজা আর বিউটি বেগমই নন। বিভিন্ন সময় সাপেকাটার পর সজিমউদ্দীনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন অন্তত ১০ জন।
কথা হয় সজিমউদ্দীনের সঙ্গে। তিনি জানান, রোগিকে যে সাপই দংশন করুক, তার ওষুধ একটিই। লবণ, মরিচ এবং গরম পানি দিয়ে সাপে কাটার বিষয়টি নিশ্চিত হলেই বাড়ির আশপাশে থাকা বিশেষ সেই ভেষজ খাওয়ান রোগিকে। এ ওষুধের চিকিৎসায় ফলাফল শতভাগ দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণের জন্য যখন ভারতে অবস্থান করছিলাম, তখন রেশন নিয়ে আসামে পাঠানো হয় আমাকে। আসামে যখন গাড়ি থেকে রেশনের মালামাল কুলিরা আনলোড করছিলো, তখন দেখলাম কয়েকজন মানুষ একজন সাপেকাটা রোগিকে নিয়ে পাশের একটি বাড়িতে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পরই চোখে পড়লো রোগিটি সুস্থ হয়ে বের হলেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওই বাড়িতে ফজলুল হক নামে একজন আলেম ব্যক্তি থাকেন, তিনিই ভেষজ ওষুধে সাপেকাটা রোগির চিকিৎসা দেন। আমি ওই বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতিটা শিখানোর আবদার করি, অনেক অনুরোধের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে এই চিকিৎসা পদ্ধতি শেখান।
মুক্তিযোদ্ধা সজিম উদ্দীন বলেন, ৫৩ বছর ধরে এলাকায় এই গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। জেলার বিভিন্ন এলাকার রোগি আমার কাছে সুস্থ হয়েছে। বিনিময়ে কোন টাকা দাবি করিনা, অনেকেই খুশি হয়ে কিছু দেন।
সজিমউদ্দীন আরও বলেন, অনেকেই আমাকে ওঝা ভাবেন। আমি ওঝা নই। ঝাড়ফুঁক করিনা, তাবিজ দেইনা। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ভেষজ দিয়ে আমি চিকিৎসা দেই, এতে মানুষের উপকার হয়।
স্থানীয় মাদ্রাসাশিক্ষক জালাল উদ্দীন বলেন, বর্ষাকাল এলেই গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয় হয়ে ওঠে সাপের দংশন। বিষধর সাপের দংশনে হরহামেশাই মানুষের মৃত্যু হয়। এ অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সজিমউদ্দীন খুবই উপকারী একজন ব্যক্তি। তার কার্যকরি ওষুধে অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয়েছে। যেহেতু বর্তমান সময়ে সাপেকাটা রোগির চিকিৎসা ব্যাপকভাবে নেই, এ অবস্থায় সজিমউদ্দীনের পদ্ধতিটা সংরক্ষণ করা গেলে কাজে দিবে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মাহাতাব প্রধান বলেন, বীরমুক্তিযোদ্ধা সজিমউদ্দীনের ওষুধ সাপেকাটা রোগির জন্য ফলপ্রসু জেনেছি। এলাকার কাউকে সাপে কাটলেই তার শরনাপন্ন হন।
পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা জামান চৌধুরী জানান, সাপেকাটা রোগিদের দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। পঞ্চগড়ে বর্তমান সাপের প্রতিষেধক ‘এ্যান্টিভেনম’ যথেষ্ট মজুদ আছে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *