নারী শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা ও বাড়িওয়ালার ছেলে কর্তৃক ভাড়াটিয়াকে খুন-‘ডেথ জোন আশুলিয়া’

হেলাল শেখ,
বিশেষ প্রতিনিধিঃ ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানাধীন জামগড়া বঙ্গমার্কেটের পিছনে মিস কুইন নামে এক নারী পোশাক শ্রমিককে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছ। এর আগে জামগড়া মনির মার্কেট এলাকায় ভাড়া বাসায় নিজ রুমে প্যারালাইজড শ্রী বিমল মন্ডল নামের এক ব্যক্তিকে মুখে কাঁচি ঢুকিয়ে কুপিয় হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, আশুলিয়া “ডেথ জোন ও আতঙ্কের জনপদ” হিসেবে পরিচিত, কিশোর গ্যাং মাদক সন্ত্রাসীসহ অপরাধীরা নির্বিঘœ জীবনযাপন করছে, অনেক অপরাধমূলক কর্মকান্ড পুলিশ জানেই না, সেই সাথে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দেয়া হয় ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা।
জানা গেছে, বুধবার (১৯ এপ্রিল ২০২৩ইং) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে এনভয় গার্মেন্টস এর নারী পোশাক শ্রমিক বাসা থেকে কর্মস্থলে ডিউটিতে যাওয়ার সময় জামগড়া নিউ বঙ্গ মার্কেটের পিছনে আসামাত্রই তাকে ছুরি দিয়ে পিছনে কুপিয়ে এবং পেটে ছুরি ঢুকিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে খুনি পালিয়ে যায়। এসময় ভিকটিমকে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। ভিকটিম মিস কুইন (২৫) পিতা মোঃ কুদ্দুস, গ্রাম ফতেপুর, থানা উপজেলা নওগাঁ। বর্তমান ঠিকানা আশুলিয়ার জামগড়া চিত্রশাইল এলাকার মোঃ ফিরোজ কবিরের বাড়ির ভাড়াটিয়া। ভিকটিম এনভয় গার্মেন্টসের সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। ভিকটিমের স্বামী মোঃ আজাদ (৩৫) নেশাখোর হওয়ায় ৬ মাস আগে তাকে ডিভোর্স দেন ভিকটিম। এ ঘটনার পর সিসিটিভি দেখে বুঝা যায়, ভিকটিমকে তার সাবেক স্বামী আজাদ তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে পালিয়েছে। খবর পেয়ে আশুলিয়া থানা পুলিশ হাসপাতাল থেক ভিকটিমের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছেন। আশুলিয়া থানার (এসআই) নোমান ছিদ্দিক বলেন, ভিকটিমের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং হত্যাকারীকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।
জানা গেছে, এর আগে গত রবিবার (১৬ এপ্রিল ২০২৩ইং) ঢাকার আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড জামগড়া উত্তর পাড়া মনির মার্কেট মসজিদের সামনে আবুল হোসেন ওরফে আবু ভুঁইয়া’র ৫ম তলা ভবনের ৩য় তলায় শ্রী বিমল মন্ডল (৫০) কে কাঁচি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নিহত বিমল মন্ডল রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানার নওরা বনগ্রাম এলাকার মৃত খিতিস মন্ডলের ছেলে। ভিকটিম তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে কাজ কর্ম করতেন পরিবারের সবাই। নিহতের স্ত্রী ও মেয়ে পোশাক শ্রমিক, বিকেল ৫টার দিকে অফিস ছুটির পর প্রথমে বাসায় আসেন, দরজা বাহির থেকে লাগানো ছিলো, দরজা খুলে বিমল মন্ডলের মেয়ে, এরপর দেখতে পায় তার বাবা খাঁটের বিছানার উপর পড়ে আছেন মুখের ভেতরে কাঁচি মরদেহ পড়ে আছে। পরে তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। রহস্য হলো, এই হত্যাকান্ডের পর ওই বাড়ির মালিক আবু ভুঁইয়া ও তার ছেলে জাহিদ হাসান বাবু (২৫), শুভ হাসান (২৩) বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তাদের বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেননি, এমনকি ঘটনাস্থলের ওই বাড়ির ভাড়াটিয়াদের হুমকি প্রদান করে মুখ খুলতে দেয়া হয়নি। তারা থানা পুলিশ প্রশাসনকে জানায়নি, ভিকটিম নিহতের প্রায় ৩-৪ ঘন্টা পর লোকজন জানাজানি হলে, বাড়ির মালিক ও তার দুই ছেলেসহ পরিবারের লোকজন পলাতক থাকে, এরপর লোকজন আশুলিয়া থানা পুলিশকে খবর দিলে রাত ৮টার দিকে পুলিশ এসে ভিকটিমের লাশ উদ্ধার করেন। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত থাকায় বাড়িওয়ালার বড় ছেলে জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করেছেন র‌্যাব-৪ এর চৌকস একটি দল। একই দিনগত রাতে আশুলিয়া থানাধীন ভাদাইল উত্তর পাড়া মোঃ কাদির হাজীর বাড়ির ভাড়াটিয়া মোঃ শফিকুল ইসলাম ওরফে শফি সুমন (২৩) এর ফাঁসি দেয়া অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে থানা পুলিশ।
জানা গেছে, এর আগে আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড ভাদাইল ক্রাইম জোন এলাকার সাদেক হোসেন ভুঁইয়া মেম্বারের বড় ছেলে মোঃ দেলোয়ার হোসেন ভুঁইয়ার ভাদাইলের নতুন একটি বাড়ির ৪র্থ তলা ভবনের ২য় তলায় গাড়ি চালক রাকিব হোসেনের স্ত্রী মোছাঃ রিপা আক্তার (১৮) এর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। স্থানীয় সরকার মার্কেট নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে নিহত রিপা আক্তারের লাশ উদ্ধার করেন আশুলিয়া থানার এসআই সুব্রত রায়। এর আগে গত (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ইং) সকাল ১০টার দিকে আশুলিয়ার জামগড়া রূপায়ন আবাসন-১ এর ১নং গেটের পাশে কফিল উদ্দিনের ৪র্থ তলার ছাদের সিঁড়ির উপর ঝুলন্ত এক নারীর লাশ উদ্ধার করে আশুলিয়া থানার এসআই রাজু মন্ডল। জানা গেছে, এই বাড়ির মালিক কফিল উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী ঘটনার দিন তার বাবার বাড়ি লালমনিরহাট ছিলেন। এদিকে কফিল উদ্দিন তার বাসায় ২য় তলায় রাতে একা ছিলেন, ৪র্থ তলার ১নং রুমের ভাড়াটিয়া ওই নারীর সাথে ওই বাসার কার কি হয়েছে? তার কারণে ভিকটিম ছাদের সিঁড়ির উপরে ফাঁসির ঘটনা ঘটে। এর আগে ওই নারীর স্বামীসহ একই বাড়ির টিনসেট ঘরের পকেট রুমে ভাড়া ছিলেন। হঠাৎ করে ৪র্থ তলার ১নং রুমে তাদেরকে আশ্রয় দেন বাড়ির মালিক কফিল উদ্দিন। স্থানীয়রা জানান, মেয়েটি কেন ফাঁসি নিবে? কেন তাকে পকেট রুম থেকে ৪র্থ তলায় স্থান পরিবর্তন করা হলো?। পুলিশ ও র‌্যাব উক্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আশুলিয়া এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ফিটিংবাজি, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- করছে অপরাধীরা। সেই সাথে নারী ও শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অনেক নারী ও শিশু।
জানা গেছে, (গত ২৪ অক্টোবর ২০২২ইং) রাত ১২ টার দিকে আশুলিয়ার জামগড়া মীর বাড়ি এলাকার মোঃ নাজিম উদ্দিন ওরফে গ্যাস নাজিম এর বাড়ির ভাড়াটিয়া মোঃ শাহজাহান (২৫) কে চুরির অপবাদ দিয়ে পরিকল্পিত ভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, নিহতের স্ত্রী মোছাঃ রোকেয়া আক্তার ওরফে রোমানা, ওরফে শিমু আক্তার পরকীয়া প্রেম করে এমন ঘটনা তার স্বামী জানতে পারায় তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ঘটনার দিন রাত ১২ টার দিকে পরকিয়া স্ত্রীর ভাই রোমান, জাহাঙ্গীর, বাড়ির মালিক নাজিম উদ্দিনসহ ৫-৬ জন কৌশল করে একটি স্বর্ণের চেইন ও মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে শাহজাহানকে নাজিমের বাড়ি থেকে মারপিট শুরু করে এবং রাস্তায় নিয়ে এসে বাটাম দিয়ে পিটিয়ে তাকে হত্যা করেছে বলে এলাকাবাসী জানায়।
গত (১৪ আগস্ট ২০২২ইং) সকাল ৯ টার দিকে ঢাকার আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের নিশ্চিন্তপুরের মৃত ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে মোঃ দিলু মন্ডল তার চাচাতো ভাই হাজী জমত আলী মন্ডল (৬৫) এর সাথে সরকারি রাস্তা ও এক ফিট জমি নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, এক পর্যায়ে হাতাহাতি হলে এ সময় দিলু জমত আলীকে কিলঘুসি মারেন এবং ইট দিয়ে নাকে ও বুকে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, নিহতের ছোট ভাই জয়নাল ও দিলু হোসেনের ছোট ভাই নজরুল ইসলাম মন্ডলের সাথে সরকারি রাস্তা ও জমি নিয়ে আগে থেকেই বিরোধ চলছিলো, এর এক পর্যায়ে তাদের এই বিরোধের জের ধরেই এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে ঘোষবাগ ৪ বছরের শিশু কন্যার ধর্ষণের চেষ্টা মামলা করে এক নারী নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাব জানায়, উক্ত ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এদিকে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেন যে, আশুলিয়ায় নিরাপদ “ক্রাইম জোন”-এ পরিণত হয়েছে, রাজধানীর নিকটবর্তী শিল্পা ল আশুলিয়া থানা। এখানে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস আর মাদক ব্যবসা যেন অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা আশুলিয়াবাসীর কাছে। এ এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই লাশ উদ্ধার হয়। অনেক দিন আগে ৯জানুয়ারি ২০১৭ইং একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে পাওয়া যায়, আশুলিয়া থেকে ১১ মাসে ১২৩টি লাশ উদ্ধার। তাই উক্ত আশুলিয়াকে ডেথ জোন ও আতঙ্কের জনপদ বলা হয়, বর্তমানে কিশোর গ্যাং মাদক সন্ত্রাসীরা আশুলিয়ায় আরও এক আতঙ্কের নাম।
আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নরুল বলেন, খবর পেয়ে শ্রী বিমল মন্ডলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সুরতহাল শেষে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। কি কারণে এই হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে তা তদন্ত শেষে নিশ্চিত ভাবে জানা যাবে বলে তিনি জানান। পুলিশ ও র‌্যাব-৪ এর একটি বিশেষ দল জানান, এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং এই হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত আছে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *