মাকে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ইমরান হোসেন এর কিছু কথা ছিলো- চান মিয়ার গল্প

মায়ের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ১৯ বছর। মহাকালের বিস্তার বিবেচনায় সময়ের এই পার্থক্য খুব বেশি নয়, কিন্তু মায়ের জীবন-দর্শন, অভিজ্ঞতা ও জানাশোনার পরিধি দেখে আমি অবাক হতাম। প্রায়ই মনে হত উনি আমার হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসেছেন। আমার চিন্তা-ভাবনার বিকাশ ও বোধশক্তির শুরুর আগে জগতে যা কিছু ঘটেছে, মা যেন সব জানেন। আমার পড়ালেখার শুরু মায়ের কাছেই। মনে পরে যখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ি, মা আমাকে হাতে ধরে লেখা শেখাতেন। শৈশবের পড়ালেখা শুরুর স্মৃতির সাথে আরেকটি মধুর বিষয় জড়িয়ে আছে। আমাদের বাড়ি ছিল ওয়াবদা বাঁধের সাথে লাগানো। পাহাড়ের মত উঁচু পথ পেড়িয়ে রাস্তায় উঠতে হত। রাস্তার ঠিক উপরে ছিল একটি টং দোকান। দোকানের মালিকের নাম চান মিয়া। তাঁর বয়স প্রায় পনের বছর তখন। তাঁদের পরিবার নদীর ওপার হতে সিকস্তি হয়ে এসেছিল। তাঁর পিতা নৌকা মেরামতের কাজ করত। চান মিয়ার আরো তিন ভাই ও ছোট দুই বোন ছিল। এরা কেউ পড়ালেখা করত না। অভাবের সংসারে পড়ালেখা শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। এ নিয়ে চান মিয়ার খুব মনোকষ্ট ছিল। সে যোগ-বিয়োগ করতে পারত। দোকানের বেচাকেনার হিসেব রাখার প্রয়োজনে মুখেমুখে শিখে নিয়েছিল। কিন্তু লিখতে পারত না। আমার চেয়ে বয়সে সে বড় হলেও সে ছিল আমার অনেকটা বন্ধুর মত। আমার কাছে সুখদুঃখের গল্প করত। সে পড়ালেখা করে নি, এইটা নিয়ে আমারও খারাপ লাগত। একদিন চমৎকার একটা ঘটনা ঘটল। চান মিয়া বর্ণমালা শেখার একটি বই কিনে ফেলল। বিকালে আমাকে বলল, সে পড়ালেখা শিখবে। আমার সেদিনের খুশি আর ধরে না। আমি মাকে এসে ঘটনাটি বললাম। মা শুনে খুশি হলেন।

চানমিয়া খুব দ্রুত অক্ষর চিনে ফেলল। লিখতেও শুরু করে দিল। সে তাঁর নাম লেখা শিখতে খুব উৎসাহী ছিল। আমি মায়ের কাছ থেকে বিভিন্ন বানান শিখে বাড়ি থেকে উঁচু ঢাল পেড়িয়ে রাস্তায় উঠে চানমিয়াকে শিখিয়ে দিয়ে আসতাম। আমার কাছে মনে হত, চান মিয়া ও আমি একই সাথে পড়তে শিখছি। মা যেন আমাদের শিক্ষক।

এক বছরের মধ্যে চান মিয়া কিছুটা পড়া ও লিখতে শিখে ফেলল। এরমধ্যে তাঁর দোকানের ব্যবসাও বাড়তে থাকল। সবকিছু ঠিকভাবেই চলছিল। সহসা একদিন চানমিয়ার পিতা কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চানমিয়ার ছোট ভাই সুরুজমিয়াকে দোকানে বসিয়ে দিলেন , চানমিয়াকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন।

চানমিয়া বাড়ি ছেড়ে পুরান ঢাকায় বসতি গড়ল। সে বুড়িগঙ্গার তীরে এক কেমিক্যালের দোকানে কাজ করত। প্রথম দিকে তাঁর কাজ ছিল নদীর কালো পানিতে কেমিক্যালের কালো ড্রাম ধুয়ে পরিষ্কার করা। কয়েকমাস পর সে দোকানে মালামাল দেখভালের দায়িত্ব পায়। চানমিয়ার সাথে আমার বছরে দুই-একবার দেখা হত। সে ঈদে-উৎসবে বাড়ি যেত। নানা রঙের জামাকাপড় পরত। আমি ভাবতাম চানমিয়া ঢাকার বড় সাহেব হয়েছে।

এখন মনে হয় চানমিয়া ঢাকায় আসতে চায়নি। সে চায়নি, পুরান ঢাকার সরু গলিতে তাঁর স্বপ্ন পুড়ে মরুক, জীবন নিয়ে হাহাকার উঠুক। সে চেয়েছিল পড়ালেখা শিখতে। গ্রামে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে নিজেকে বদলিয়ে দেয়ার এক সুখস্বপ্নের নাম ছিল চানমিয়া।
লেখাটা পেজবুক পেজ থেকে সংগ্রহ করা।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *