স্বরূপকাঠির সম্ভাবনাময় জাহাজ শিল্প

আনোয়ার হোসেন স্বরূপকাঠি (পিরোজপুর) প্রতিনিধি //

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা স্বরূপকাঠি উপজেলা কালের বিবর্তনের সাথে সাথে শিল্প কারখানার অঞ্চলে হিসেবে রুপান্তরিত হতে চলছে। এবং সেই সংগে সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবকদের
কর্মসংস্থানের।

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ডকইয়ার্ড বা জাহাজ নির্মানের কারখানা। ছোট বড় মিলিয়ে রয়েছে ২০টি ডকইয়ার্ড। এই গকইয়ার্ড বা জাহাজ নির্মান কারখানায় ১০/১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

এর পূর্ব স্বরূপকাঠিতে কাঠের ব্যাবসা, ও নার্সারি ব্যাবসার জন্য বিখ্যাত ছিলো। পাশাপাশি রোপ শিল্প, ক্রিকেট ব্যাট, ছোবরা শিল্প এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প বা ডকইয়ার্ড। এই ডকইয়ার্ডে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

স্বরূপকাঠি ব্যাবসা বানিজ্যের বেশির ভাগ কাঁচামাল নদী পথে পরিবহন করা হয়। খরচ কম এবং সহজতর বিধায় এখানে আশির দশক থেকে বড় বড় নৌকা ট্রলার মেরামত ও তৈরির জন্য গড়ে ওঠে ডকইয়ার্ড। ধীরে ধীরে ঐ ডকইয়ার্ড ব্যাবসায় সফলতা আসে এবং বাড়তে থাকে ডকইয়ার্ডের সংখ্যা, রূপ নেয় মানসম্পন্ন জাহাজ তৈরির কারখানায়। বর্তমানে ছারছীনা ডকইয়ার্ডে মেসার্স পাতারহাট সিপিং লাইন্স এর এম ভি দোয়েল পাখি ১০ নামে বিলাশ বহুল লাঞ্চের কাজ চলমান রয়েছে।

এখানে ৩০ বছর ধরে জাহাজ নির্মাণের কাজ চলছে। এর আগে হাতে গোনা কয়েকটি ডকইয়ার্ডে ছোট আকৃতির জাহাজ তৈরি হলেও ২০০০ সালের পর থেকে এই ব্যবসা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। ফলে ২০ টিরও বেশি ডকইয়ার্ডে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০/১৫ হাজার বেকার যুবকদের।

তবে এই জাহাজ শিল্প কারখানায় যারা কাজ করেন তাদের অনেকেরই নাই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবু তারা মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের মতো অনায়াসেই বড় বড় জাহাজ নির্মাণ করে চলছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে এমনকি তাঁদের নেই ভালো কোন সেফটির ব্যাবস্থা। এই সকল শ্রমিকদের যদি জাহাজ নির্মান বিষয়ে প্রোপার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এর থেকেও বড় বড় আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ তৈরি করতে পারবে। এই জাহাজ নির্মান শিল্পকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, হার্ডওয়্যার ও রঙসহ স্টিলপাতের শতাধিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে এবং ঐ সকল প্রতিষ্ঠানে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। স্বরূপকাঠি উপজেলা নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষও কর্মসংস্থানের খোঁজে ছুটে আসেন এখানে।

কালিবাড়ি খালের তীরে গড়ে ওঠা চৌধুরী ডকইয়ার্ড এর মালিক গোলাম সরোয়ার বলেন, আমাদের এই সকল ডকইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে নতুন আধুনিক মানের জাহাজ, পাশাপাশি মেরামত করা হচ্ছে পুরাতন জাহাজ। আন্তর্জাতিক নৌ রুট থাকায় ডকইয়ার্ডগুলো আধুনিকায়ন করে তৈরি করছে উন্নত মানের ছোট-বড় নানা আকৃতির জাহাজ, লঞ্চ, ট্রলার ও বালুবহনকারী কার্গোসহ প্রায় সব ধরনের লোহার তৈরি নৌযান। এখানে বর্তমানে ৩০ ফুট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা জাহাজ তৈরি হচ্ছে। একটি বড় জাহাজ তৈরি করতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ মাস এবং একটি জাহাজ তৈরি করে ঠিকাদারদের ২ থেকে ৩ লাখ টাকার বেশি লাভ হয়।

ডকইয়ার্ড মালিকদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায় প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে থেকে এ উপজেলায় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয়। বর্তমানে এখানে মান সম্পন্ন ও বড় আকারের জাহাজ তৈরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত করতে আসেন। তারা আরও জানান জাহাজ নির্মাণের কাঁচামাল ঢাকার পোস্তা খোলা , চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, কক্সবাজার ও সিলেট থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া কিছু কাঁচামাল ও মেশিনপত্র বিদেশ থেকেও আমদানি করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় এসব কাঁচামাল এখানে পৌঁছাতে দেরি হয়, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায়, বিশেষ করে সন্ধ্যা নদীতে ব্রিজ না থাকায় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ভারি ও দামি মালামাল পরিবহন করতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলে আমরাও লাভবান হবো এবং এই শিল্পই হতে পারে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের উৎস

নেছারাবাদ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোশারেফ হোসেন বলেন, সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে সম্ভাবনাময় জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প গড়ে ওঠায় এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এই শিল্প বিকাশে সরকারিভাবে যেসকল উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় তার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আনোয়ার হোসেন
স্বরূপকাঠি (পিরোজপুর) প্রতিনিধি।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *