September 17, 2024, 2:36 pm
বি এম মনির হোসেনঃ-
বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার মাষ্টার মাইন্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তার (রিফাত) স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকেও হার মানিয়েছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পিঙ্গলকাঠী গ্রামের রাবেয়া আক্তার মুসকান। পুরনো প্রেমিকের সাথে ঘর বাঁধার জন্য স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন নববধূ মুসকান (১৯)। যে কারণে কৌশলে স্বামীকে দুটি ঘুমের ওষুধ সেবন করিয়ে দেয়। পরে প্রেমিক ও তার বন্ধুুর সহায়তায় স্বামীকে হত্যার উদ্দেশে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। আর পুরো ঘটনাটি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মুসকান। ঘটনাচক্রে স্বামীকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতলে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার সাতদিনের মধ্যে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী স্ত্রী রাবেয়া আক্তার মুসকান, তার প্রেমিক আবু সাইদ সিয়াম এবং সিয়ামের বন্ধু রায়হান খন্দকার ও জিহাদ হাসান রাজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে সিয়াম ও রায়হানের বাড়ি গৌরনদী এবং রাজনের বাড়ি জামালপুরে। তবে সিয়াম ও রাজন গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকায় বসবাস করে আসছিল। ১ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বরিশালের পুলিশ সুপার মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। লিখিত বক্তব্যে পুলিশ সুপার বলেন, গত ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে গৌরনদীর কালনা এলাকার রাস্তার ওপর সৌরভ বেপারী নামের এক যুবককে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে গুরুত্বর আহত করে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা মুমূর্ষ অবস্থায় আহতকে উদ্ধার করে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সৌরভকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সূত্রমতে, বিষয়টি জানতে পেরে গৌরনদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম আল বেরুনী, গৌরনদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আফজাল হোসেন, পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত মোঃ হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম ঘটনার মূলরহস্য উদ্ঘাটন ও হামলাকারীদের শনাক্তের কাজ শুরু করেন। পুলিশ সুপার বলেন, তদন্তের শুরুতেই বিভিন্ন তথ্য ও সন্দেহজনক আচরণ পরিলক্ষিত হওয়ায় ঘটনার একমাত্র প্রতক্ষদর্শী সৌরভের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার ওরফে মুসকানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। প্রথমে মুসকান এলোমেলো তথ্য দিলেও পরবর্তীতে তিনি স্বেচ্ছায় ঘটনার বিবরণ দেন। ওই সময় মুসকান জানান, সৌরভ বেপারীর সাথে সাড়ে তিনমাস আগে তার (মুসকান) পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় সৌরভ বলেছিল, সে সরকারি চাকরি করে এবং মুসকানকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেবেন। তবে বিয়ের পর মুসকান জানতে পারে সৌরভ সরকারি চাকরি নয়, ঢাকায় একটি প্রাইভেট ব্যাংকের গাড়ি চালক। অপরদিকে বিয়ের পর মুসকানের আগের বন্ধু বান্ধবের সাথে সম্পর্কের বিষয় ও সাংসারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সৌরভের মনোমালিন্য দেখা দেয়। যা নিয়ে মুসকান তার স্বামী সৌরভের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়। একপর্যায়ে মুসকান কার বিয়ের আগের সম্পর্কিত প্রেমিক আবু সিয়ামের সাথে নতুন করে সংসার করার জন্য সিয়াম ও তার বন্ধু রাজনদের সহযোগিতায় সৌরভকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পুলিশ সুপার বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি ছুটিতে সৌরভ ঢাকা থেকে গৌরনদীর পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের বাড়িতে আসে। পরেরদিন দুপুরের খাবার গ্রহণের পর সৌরভকে ভিটামিন ওষুধ বলে দুটি চেতনানাশক (ঘুমের) ওষুধ খাওয়ায় মুসকান। ওইদিন বিকেলে কেনাকাটার জন্য সৌরভের সাথে মুসকান গৌরনদী উপজেলা সদরে যায় এবং কৌশলে মোবাইল ফোনে প্রেমিক সিয়ামকে খবর দেয়। সন্ধ্যায় সৌরভ অসুস্থবোধ করলে স্ত্রী মুসকান তাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বান্ধবীর বাসায় যাওয়া কথা বলে অটোরিকশা থেকে মুসকান তার স্বামী সৌরভকে নিয়ে সড়কের কালনা নামক এলাকায় নেমে যায়। পরবর্তীতে কালনা এলাকার শামসুল হকের বাড়ির পূর্ব পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সৌরভ বেপারীকে স্ত্রী মুসকানের প্রেমিক সিয়াম, তার বন্ধু রাজন ও রায়হানসহ তাদের অন্যান্য সহযোগিরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার উদ্দেশে কুপিয়ে জখম করে। এতে সৌরভের গলার উপরের অংশে, ঘাড়ের নিচের অংশে, গালে, কানেসহ দুই হাতে গুরুত্বর রক্তাক্ত জখম হয়। হামলার সময় স্ত্রী মুসকান স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে নীরবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে পুরো বিষয়টি দেখেন। তবে গুরুত্বর আঘাতপ্রাপ্ত সৌরভের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে হামলাকারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৌরভ বেপারীর বাবা পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের বাসিন্দা কবির হোসেন বেপারী বাদি হয়ে গৌরনদী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার প্রধান আসামি মুসকান ও রায়হান খন্দকারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি আদালতে সোপর্দ করা হয়। তখন তারা ঘটনার বিবরণ দিয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। যার প্রেক্ষিতে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে গৌরনদী মডেল থানার একটি আভিযানিক দল ৩১ জানুয়ারি গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানাধীন দত্তপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামলার অপর আসামি আবু সাইদ সিয়াম ও জিহাদ হাসান রাজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী হামলায় ব্যবহৃত রক্তমাখা চাপাতি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়। বুধবার শেষ কার্যদিবসে গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ১৪ নভেম্বর গৌরনদীর পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের কালাম গাজীর মেয়ে রাবেয়া আক্তার মুসকানের সাথে একই গ্রামের কবির বেপারীর ছেলে সৌরভ বেপারীর (২৮) সামাজিকভাবে বিয়ে হয়।