April 25, 2024, 8:27 am

বিজ্ঞপ্তি :
বিশেষ সতর্কীকরন - "নতুন বাজার পত্রিকায়" প্রকাশিত সকল সংবাদের দ্বায়ভার সম্পুর্ন প্রতিনিধি ও লেখকের। আমরা আমাদের প্রতিনিধি ও লেখকের চিন্তা মতামতের প্রতি সম্পুর্ন শ্রদ্ধাশীল। অনেক সময় প্রকাশিত সংবাদের সাথে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে। তাই যেকোনো প্রকাশিত সংবাদের জন্য অত্র পত্রিকা দায়ী নহে। নতুন বাজার পত্রিকা- বাংলাদেশের সমস্ত জেলা, উপজেলা, ক্যাম্পাস ও প্রবাসে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে! বিস্তারিত: ০১৭১২৯০৪৫২৬/০১৯১১১৬১৩৯৩
শিরোনাম :
নড়াইলে ষাঁড়ের লড়াই প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার বিতরণ স্বরূপকাঠিতে ধর্ষনের অভিযোগে চেয়ারম্যানের ভাগনে গ্রেফতার গোদাগাড়ীতে চাঁদাবাজি মামলায় প্রভাবশালী দলের দুই যুবক গ্রেপ্তার মরনবাধ ও ভারতের বৈরী আচরণের প্রভাবে মহানন্দা নদীর বেহাল দশা বাবুগঞ্জে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী এসএম খালেদ হোসেন স্বপন এর সমার্থনে সভা নলছিটিতে আদালতের আদেশ অমান্য করে ভবন নির্মাণের অভিযোগ ময়মনসিংহ সদরের কুষ্টিয়া ইউনিয়নে শত্রুতা করে ফসলের ক্ষতি করার অভিযোগ তীব্র তাপদাহে খেটে খাওয়া মানুষের পাশে ভালুকার ওসি কামাল সিরাজদিখান রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন কেশবপুরে বিএনপি নেতা পৌর কাউন্সিলর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪ হাজার পিচ স্যালাইন বিতরণ
আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে খেতুর ধামে শুরু হবে শ্রী শ্রী নরোত্তম ঠকুরের তিরোভাব তিথিতে মহোৎসব। আসবেন দেশ বিদেশের লাখ লাখ ভক্ত।

আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে খেতুর ধামে শুরু হবে শ্রী শ্রী নরোত্তম ঠকুরের তিরোভাব তিথিতে মহোৎসব। আসবেন দেশ বিদেশের লাখ লাখ ভক্ত।

মোঃ হায়দার আলী রাজশাহী থেকেঃ আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী খেতুরধামে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবছর ঠাকুর শ্রী শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের তিরোভাব তিথিতে এ মহোৎসবের আয়োজন করা হবে। সারা পৃথিবীতে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের ধামের সংখ্যা মাত্র ছয়টি। এর মধ্যে পাঁচটিই ভারতে অবস্থিত। আর একটি বাংলাদেশের এই খেতুর ধাম।

মহোৎসব উপলক্ষ্যে প্রতি বছরের মত এবারও দেশ-বিদেশ থেকে ঠাকুর শ্রী শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের এ মহোৎসবে দেশ বিদেশের কয়েক লাখ ভক্তসমবেত হবেন এখানে। মহোৎসবকে কেন্দ্র করে বসবে বড়ধরনের মেলা। এনিয়ে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টি বোর্ড। আয়োজন নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও গ্রহণ করা হচ্ছে ব্যাপক প্রস্তুতি।

রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের প্রেমতলীর গৌরঙ্গবাড়ীতে খেতুর ধাম অবস্থিত। এই ধামে প্রতিবছর বাংলা কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত এখানে চলে মেলা ও সংকীর্তন। প্রেমতলীতে গৌরাঙ্গবাড়ি নামে একটি বৈষ্ণবীয় তীর্থস্থান অবস্থিত। এই বাড়িতে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দের বাংলা মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন ঠাকুর নরোত্তম দাস (১৫৩১-১৫৮৭)। তার তিরোভাব তিথি উপলক্ষে এখানে তিন দিন ব্যাপি মেলা ও মহোৎসবের আয়োজন করা হবে ।

দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ভক্ত এখানে মহোৎসবে যোগদান করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, মণিপুর ইত্যাদি রাজ্য থেকে বৈষ্ণব ভক্তরা এখানে এসে সমাবেত হয়। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ভক্তের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠবে খেতুর ধাম। বৈষ্ণব ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হয় সন্ন্যাসী ও বাউল ভক্তরা। আসামের কামাক্ষা থেকে প্রতিবছর এখানে সন্নাসীদের আগমন ঘটে। ভারত ছাড়াও নেপালের পুণ্যার্থীরা এই মেলায় আসে। এছাড়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)-এর উদ্যোগে ফ্রান্স, আমেরিকা, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ থেকে ভক্তরা এই মেলায় আসে। হাজার হাজার ভক্তের পদচারণা আর প্রার্থনায় প্রেমতলী আর গৌরাঙ্গবাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। মেলা উপলক্ষে তৃতীয় দিনে গোদাগাড়ী এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ২৪ ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই মেলাকে ‘বৈষ্ণবের মহামিলন’ বলে অভিহিত করা হয়।

ঠাকুর নরোত্তমের জন্ম সম্পর্কে কিংবদন্তী হলো— ‘একবার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পার্ষদ ভক্তদের নিয়ে নদীয়ায় মহানাম কীর্তন করছিলেন। হঠাৎ মহাপ্রভুর চোখ প্রেমতলীর খেতুর গ্রামের দিকে গেল। মহাপ্রভু তৎক্ষনাৎ ‘নরোত্তম, নরোত্তম’ বলে কেঁদে উঠলেন। এর পর মহাপ্রভু প্রয়াণের বহু বছর পর পদ্মা নদীর তীরে গোপালপুর নগরের রাজা রাজা কৃষ্ণানন্দ ও শ্রী নারায়ণী দেবীর ঘরে মাঘ মাসে শুক্ল পঞ্চমীতে শ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। বয়োবৃদ্ধি হলে নরোত্তম ঠাকুর ভক্তমুখে শ্রী গৌরসুন্দর ও নিত্যানন্দের মহিমা শ্রবণ করে পরম আনন্দ অনুভব করলেন। গৌরলীলা স্থান দর্শনের অভিলাষে সংসার ত্যাগ করে বৃন্দাবন ধামে গমন করলেন। সেখানে শ্রী লোকনাথ গোস্বামীর কাছে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলেন এবং শ্রীল জীব গোস্বামীর কাছে বৈষ্ণব দর্শন শিক্ষা লাভ করলেন। এরপর ঠাকুর এক বিপ্রের ধানের গোলা থেকে গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া বিগ্রহ উদ্ধার করে খেতুরে প্রতিষ্ঠা করলেন।’

মেলার সময় গৌরাঙ্গ বাড়ির চারিদিক থেকে লোক আসতে থাকে। ভক্তদের অনেকে সদলবলে কীর্তন করতে করতে উৎসব প্রাঙ্গনে ঢোকে। তাদের মধ্যে কেউ মৃদঙ্গ, কেউ করতাল, শঙ্খ, হারমোনিয়াম, বেহালা ইত্যাদি বাজিয়ে নগর কীর্তন করতে করতে উৎসব স্থলে প্রবেশ করে। চার দিন ব্যাপি নামকীর্তন চলে। তৃতীয় দিন হলো অষ্টপ্রহর নামকীর্তনের নির্ধারিত দিন।

শ্রীচৈতন্য তিরোধানের পাঁচ দশক পর পদাবলী কীর্তনের সূত্রপাত হয়। নরোত্তম ঠাকুর এই প্রথাবদ্ধ পদাবলী গায়নের সূত্রপাত করেন। তিনি ১৫৮৩ মতান্তরে ৮৪ খ্রিস্টাব্দে খেতুরিতে এক বৈষ্ণব মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে তিনি সর্বপ্রথম গৌরচন্দ্রিকা গায়নসহ প্রণালীবদ্ধভাবে লীলাকীর্তন গাওয়ার প্রস্তাব করেন। এই উৎসবে উপস্থিত বৈষ্ণব কবি, দার্শনিক, রসবেত্তা ও গায়কেরা সেটি অনুমোদন করেন। তখন থেকে খেতুরি উৎসব ব্রজবুলির পদ এবং গৌরচন্দ্রিকা গায়নসহ প্রণালীবদ্ধ লীলাকীর্তনের প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠে। নরোত্তম যে পদাবলীকীর্তন প্রবর্তন করেন তার বৈশিষ্ট্য হলো— লীলাকীর্তনের পূর্বে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া, পরিবেশনের জন্য যে পালা গঠিত হবে তাতে পদকর্তাদের মর্মানুসারী পদ সংকলন, মৃদঙ্গের ব্যবহার, তালছন্দ রচনা এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কীর্তন আলাপের মধ্য দিয়ে কীর্তন পরিবেশন। এভাবে নরোত্তম প্রবর্তিত কীর্তনের একটি আলাদা ঘরানা তৈরী হয়। খেতুরি ছিল রাজশাহীর গড়েরহাটী পরগণার অধীন। উৎস স্থলের নামানুসারে এই কীর্তন ধারার নাম হয় গরানহাটী বা গড়েরহাটী ঘরানা।

চরিদিক থেকে লোক মেলায় আসতে থাকে। ভক্ত, দর্শনার্থী, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, গবেষক, ব্যবসায়ীর, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ মেলায় আসে। এছাড়া এই মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পেশাজীবী শ্রেণি তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। মেলা প্রাঙ্গনের চারি দিক ঘিরে থাকে নানা প্রকার দোকান। এক এক দিকে এক এক প্রকার দোকানীদের পসরা সাজিয়ে বসতে দেখা যায়। কোথাও বাদ্যযন্ত্র বিশেষ করে মৃদঙ্গ, পূজার উপকরণ ও ধর্মীয় গ্রন্থ বিক্রি হয়। এই সব স্থানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের উপর তাদের প্রচারমূলক গ্রন্থ বিক্রি করে। অন্য দিকে থাকে নানা প্রকার খাবারের দোকান। মাছ-মাংসসহ ভাত খাওয়ার হোটেল যেমন দেখা যায় তেমনি নিরামিষ খাবারেরও দোকান লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া অস্থায়ী বিভিন্ন মিষ্টির দোকান গড়ে ওঠে। খেতে পাওয়া যায় চিড়া-দৈ। খাবার হিসেবে ডালপুরি, সিঙ্গাড়া, পিঁয়াজি ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরী হয়। একদিকে দেখা যায় চানাচুর, খোরমা, চিনাবাদাম, বাতাসা, খাজা ইত্যাদির দোকান। এই সকল দোকান পেরিয়ে মনোহরী পট্টি। এখানে বিভিন্ন প্রকার প্রসাধনী, খেলনা ইত্যাদির ঘটা দেখতে পাওয়া যায়। কুমারদের দোকানে দেখা যায় হাড়ি, পাতিল, মাটির পুতুল, ব্যাঙ্ক, খেলনা, ফুলদানী, গয়না, টেরাকোটা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ছুতারেরা বিক্রি করে কাঠের তৈরী জিনিসপত্র। এর মধ্যে পিড়ি, জলচৌকি, খাট, পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল, আলমারী, আলনা, শোকেস, ড্রেসিংটেবিল ইত্যাদি দেখা যায়। ওঠে কামারদের তৈরী জিনিসপত্র। যেমন, দা, কুড়াল, খোন্তা, কোদাল, শাবল, বটি, কাঁস্তে, ছুরি, হাঁসুয়া, চাপাতি, নাঙ্গলের ফলা, নারকেল কোরানী ইত্যাদি। মেলার বাইরের দিকে খোলা মাঠে দেখা যায় সার্কাস প্যাণ্ডেল। এর কিছু দূর গিয়ে দেখা যায় নাগরদোলা।

পুরো উৎসব স্থল জুড়ে ভক্তরা শুয়ে-বসে কাটায়। অনেক ভক্তদের রান্না করা উপকরণ নিয়ে আসে। এছাড়া মেলায় চাল-ডাল-আনাজ-তরকারী কেনার ব্যবস্থাও থাকে। সেখান থেকে ভক্তরা রান্নার উপকরণ কিনি নিয়ে রান্না করে। আবার মন্দির কর্তৃপক্ষ ভোগের ব্যবস্থা করে। অনেক ভক্ত পূর্বপুরুষের নামে, দেবতার নামে ভোগ উৎসর্গ করে। ভক্তদের খাওয়ায়। সেখান থেকেও দর্শনার্থীদের খাওয়ার যোগান হয়। খাওয়া ছাড়াও ভক্তদের থাকার জন্য বিভিন্ন বিভিন্ন প্যাণ্ডেল তৈরী করে দেওয়া হয়। সেখানে তারা রাত্রি যাপন করতে পারে। আবাসনের স্থানেও গুচ্ছে গুচ্ছে কীর্তন দল দিন, রাত কীর্তন করে। কীর্তনের মধ্যে আছে পালা কীর্তন, নামকীর্তন, গৌর কীর্তন ইত্যাদি।

মেলার একদিকে আছে ইসকন সাধুদের প্যাণ্ডেল। তারা সেখানে কীর্তন করে ও তাদের প্রকাশিত ধর্মীয় গ্রন্থ, পূজার উপকরণ, জপের মালা, গলার মালা, তিলক মাটি, চন্দন ইত্যাদি বিক্রি করে। এই প্যাণ্ডেলে অনেক বিদেশী ভক্তের আগমন ঘটে। অনেক স্থানে খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগে যিশুর বাণী প্রচার করা হয়। এছাড়া হিন্দু ধর্মের অন্যান্য উপাসক সম্প্রদায়ও এই মেলাকে ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, সৎসঙ্গী, মতুয়া এঁদের ধর্মগ্রন্থের দোকানও এই মেলায় লক্ষ্য করা যায়। মূলত খেতুর মেলা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষের একটি মিলন মেলা হিসেবে বর্তমানে সার্বজনীন চরিত্র লাভ করেছে।

মূলত হিন্দু ধর্মের লোক জনের এ মেলা হলেও এলাকার মসুলমানগণ এ মেলার কার্যক্রম সুন্দর, সুচারুরুপে সম্পূন করা জন্য শত কষ্ট সহ্য করে সাহায্য করে থাকেন। প্রেমতলী ডিগ্রী কলেজ, প্রেমতলী সুকবাসিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, প্রেমতলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এলাকার বিভিন্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে হাজার হাজার গাড়ী পার্কিং এর ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারিগন তাদের যে কয় দিন অনুষ্ঠান চলে সে কয়দিন আন্তরিকভাবে সহযৌগিতা করে থাকেন।

এ প্রসঙ্গে শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গঁদেব ট্রাষ্ট বোর্ড পরিচালনা কমিটির সদস্য ও সাবেক উপপরিচালক কাষ্টম গোয়েন্দা শ্রী সুনন্দন দাস রতন বলেন, নরোত্তমের সাহিত্যকর্মও মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যের ইতিহাসে অতুলনীয় সম্পদ। বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব শাস্ত্রেরই রসভাষ্য। প্রধানত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিচিত্র পর্যায় বর্ণনাই এর উদ্দেশ্য; নর-নারীর পার্থিব প্রেমের সকাল ভাবানুভবের মধ্যদিয়ে পারমার্থিক প্রেমতত্ত্বের এক অতুলনীয় মহিমা পদাবলী সাহিত্যে বিধত। পর্ববাগ অনুরাগ অভিসার মান. মান. মিলন. বিরহ. প্রার্থনা, আত্মনিবেদন প্রভৃতি ধারাক্রমের মধ্য দিয়ে [রাধাকৃষ্ণ প্রেম বৈষ্ণব পদাবলীতে এমন এব তত্ত্বে উপনীত হয়েছে, যেখানে অক্তের সঙ্গে ভগবানের জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার, সীমার সঙ্গে অসীমের এক মহামিলনের, এক অপার্থির পূর্ণতার অভিপ্রায়ই ব্যক্ত হয়েছে। এজন্য পদাবলী সাহিত্যের আবেদন শুরু ভক্ত বেষ্ণব সমাজের মধ্যেই সীমিত থাকেনি, তা দেশকাল থাকেনি, তা দেশকাল নির্বিশেষে সকল মানুষের আত্মিক আকুতিকেই অভিব্যক্ত করেছে। আমাদের ধর্মে বৈষ্ণব কূলের শ্রেষ্ট বৈষ্ণব বলা হয় শ্রী শ্রী নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়কে। প্রেমভক্ত মহারাজা বৈষ্ণব কুলের ছড়া মনি বলাই পদাবলী কীর্তনের সৃষ্টিকারি উনার জন্ম স্থান প্রেমতলী খেতুর ( আতুর ঘর) হিন্দু ধর্মে ৬ টি ধাম আছে, তার মধ্যে ৫ টি ভারতে বিন্দাবন, পুরি, গয়া কাসি, নবদীপ আর ১ টি বাংলাদেশের রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর ধাম। দেশের খেতুরী ধাম ধর্মীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত চৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য হচ্ছে নরোত্তম ঠাকুর। তিনি আরো বলেন, হিন্দু ধর্ম মতে, তিন ধাম বিন্দাবন, পুরি, নবদ্বীপ ধামে তিন রাত্রী যাপন করলে যে মাহত (পুন্য) লাভ করা যায় আর এ খেতুর ধামে ১ রাত্রী যাপন করলে সমপরিমান (মাহত) পুন্য লাভ হয়। শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের তিরোভাব বড় অনুষ্ঠান। এ উৎসবে দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাবেশ ঘটে, এসব ভক্তদের সেবার জন্য খেতুরী ধামের ট্রাষ্ট বোর্ড সদস্যরা মন্দির চত্তরে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন এবং মন্দিরের চারিপাশে ৫০ থেকে ৬০ জন গুরুদেব পৃথকভাবে তাদের ভক্তদেরকে নিয়ে এসে পৃথক পৃথক প্যান্ডেল তৈরী ভক্তসহ আগত যাত্রীদের নিজ খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। এখানে নরোত্তম ঠাকুরের বিচরণ অংশ হিসেবে আরো ৪ টি বিচরণ অংশ রয়েছে। ভজনতুলি যেখানে তিনি ভজন করতেন, খিললতুলি, দন্ততুলি একটি বড় পুকুর আছে সেখানে তিনি স্নান করতেন, মুখ চোখ ধৌত করতেন, তমালতোলা। এগুলি বিচরন স্থান।

বদ্রীনাথ, দ্বারকা, পুরী ও রামেশ্বরম- এই চার তীর্থক্ষেত্রকে একত্রে ‘চারধাম’ বলে। বিশ্বাস করা হয় যে, এই চার তীর্থ দর্শনে মোক্ষ অর্জন করা সম্ভব। আদি শঙ্করাচার্য এই চারধামের কথা বলে গিয়েছেন। খেয়াস করে দেখুন এই চারটি তীর্থস্থলের অবস্থান ভারতের চারটি ভিন্ন অঞ্চলে। বদ্রীনাথ উত্তরের উত্তরাখণ্ডে, দ্বারকা পশ্চিমের গুজরাটে, পুরী পূর্বের ওড়িষায় এবং রামেশ্বরম দক্ষিণের তামিলনাডুতে অবস্থিত। আদি শঙ্করাচার্য এই চার ধামেই মন্দির স্থাপনা করেছিলেন।

বদ্রীনাথঃ মনে করা হয়, বিষ্ণুর অবতার নর-নারায়ণ বদ্রীনাথে তপস্যা করার পর থেকে এখানকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। সে সময় এখানে প্রচুর বেরিগাছ ছিল। সংস্কৃতে বেরিকে ‘বদরি’ বলে। নর-নারায়ণ যেখানে তপস্যা সেখানে তাঁকে বৃষ্টি ও রোদের হাত থেকে বাঁচাতে মা লক্ষ্মী নিজে একটি বড় বদরি গাছে রূপান্তরিত হন। এ সবই সত্যযুগের ঘটনা। তাই বদ্রীনাথ প্রথম ধাম হিসেবে পরিচিতি।

রামেশ্বরমঃ ত্রেতাযুগে ভগবান রাম ভগবান শিবের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য এখানে শিব লিঙ্গ তৈরি করে পুজো করেছিলেন। রামেশ্বরম কথার অর্থ রামের ঈশ্বর। এটি তাই দ্বিতীয় ধাম।
দ্বারকাঃ এটি তৃতীয় ধাম। দ্বাপর যুগে মথুরা পরিত্যাগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে থাকতে শুরু করেন। সেই থেকে তীর্থক্ষেত্র হিসেবে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।
পুরীঃ পুরীতে ভগবান জগন্নাথ কলিযুগের অবতার হিসেবে পূজিত হন। পুরীকে তাই চতুর্থ ধাম হিসেবে মনে করা হয়।
ছোট চারধামঃ বদ্রীনাথ-সহ উত্তরাখণ্ডের আরও তিনটি প্রাচীন তীর্থস্থান যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথকে একত্রে ছোট চারধাম বলা হয়।

এ প্রসঙ্গে শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গঁদেব ট্রাষ্ট বোর্ড পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপদ সান্যাল সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ১৩ অক্টোবর অধিবাস, ১৪ অক্টোবর মূল মহা উৎসব এবং বাসি মহা উৎসব ও মহন্তবিদায় অনুষ্ঠিত হবে।
মূল কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাব কমিটির মাধ্যমে সমন্বয় করে কাজগুলি সুন্দর সুচারুভাবে করা হয়। তিন দিন পূর্বে থেকে ভক্তদের সমাগম ঘটে থাকে, সব সময় ২ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি থকে। ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবাই আগত মানুষের সাহায্য করে থাকেন। এলাকার মসুলমান ভাই, বোন নিজেদের অনেক কষ্ট সহ্য করে আগত ভক্তদের সাহায্য করে থাকেন বলে তিনি জানান। গোদাগাড়ী থানা পুলিশ, জেলা পুলিশের ৫০০ জন সদস্য, ৩০ জন আনসার, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী, চিকিৎসক, ২ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত কাজ করে থাকেন। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারিগন দিনরাত পরিশ্রম করে থাকেন। ১৬ টি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে ৩০ বিঘা জমির উপর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ মহা উৎসব সুষ্ঠভাবে করার জন্য সকলের সাহায্য কামনা করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত বর্তমানের গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জমিদার কৃষ্ণ নন্দদন্ত দাস, মা নারায়ণী রাণী। গোপালপুরে শৈশব অতিবাহিত করে ঠাকুর শ্রী শ্রী নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে নিখিল বৈষ্ণবকুল লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্বগ্রহণ করে ধর্মীয় দীক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি খেতুরে ফিরে আসেন। খেতুর মন্দিরে গড়ে তোলেন স্থাপনা। এরপর তিনিই প্রথমে এখানে এ উৎসবের আয়োজন করেন। ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে এসে দীক্ষাগ্রহণ করতে শুরু করেন।

১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর শ্রী শ্রী নরোত্তম দাসের দেহ সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিয়ে যায়। তখন থেকেই নরোত্তমের কৃপা লাভের আশায় প্রতিবছর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা খেতুরীধামে তার তিরোভাব তিথি মহোৎসবে মিলিত হন। দিনে দিনে তার ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে।

মোঃ হায়দার আলী
রাজশাহী

Please Share This Post in Your Social Media






© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Design & Developed BY AMS IT BD